ঘুম থেকে উঠে লালমোহন বাবু ওরফে জটায়ু খবরের কাগজটা বাঁহাতে ধরে সবে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েছে ওমনি মোবাইলটা বেজে উঠলো। কাগজটা তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে ফোনটা ধরতে গিয়ে খানিকটা চা ছলকে পড়লো। যাইহোক ওধার থেকে এক ধীর স্থির গলা শুনে আরও চমকে উঠলো।
' হ্যালো লালমোহন বাবুতো! ব্যোমকেশ বলছি, কেমন আছেন।'
তিন বার কেশে গলা পরিস্কার করে জবাব দেয় ' হ্যাঁ, মানে ভালো আছি, কিছু বলবেন?'
'আরে বলবো আর কি, আপনার খোঁজ পাইনি অনেক দিন তাই ফোন করলাম। এখন তো আপনাদের হাতে তেমন কোন কাজ নেই...।'
'ইয়ে আর কি ফেলুবাবুর শরীরটা বেশ কিছুদিন ঠিক যাচ্ছেনা তাই ঘরেই আছি, আর ইদিকে আমার সাম্প্রতিক রহস্য কাহিনীও শেষ করে প্রেসে দেওয়ার পর একদম ফ্রি।'
'বাঃ, তাহলে আর দ্বিধা কেন চলে আসুন, চুটিয়ে গল্প করা যাবে। আরে অত না ভেবে আজ সন্ধ্যা বেলায় চলে আসুন।'
'অগত্যা' বলে লালমোহন বাবু ফোনটা রেখে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই একরাশ চিন্তা নিয়ে ভাবতে থাকে। প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারতে একটু দেরি হয়ে গেলো তারপরে ১০টা নগাদ ড্রাইভারকে গাড়িটা বের করত বলে। লালমোহন বাবু এখন গাড়ি পাল্টেছে, সবসময়ের মানে সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা অব্দি ড্রাইভার রেখেছে। পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
গাড়ি নিয়ে সোজা ফেলুবাবুর বাড়িতে হানা। সকাল সকাল ব্যোমকেশের ফোনটা ভাবিয়ে তুলেছে। ব্যাপারটা কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। লালমোহনের মগজাস্ত্র এতটা ক্ষুরধার নয়। তাই আজকাল লেখাগুলো প্রেসে দেওয়ার আগে ফেলুবাবুকে চোখ বোলাতে অনুরোধ করে। মাঝে মাঝে দুএকবার দেখে দিলেও প্রতিবারতো হয়না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কলিং বেল টিপে জানতে পারা গেল ফেলুবাবুকে নিয়ে তোপসে হাসপাতালে চেকআপ করতে গেছে। ডায়েরির পাতা উল্টে দেখলো ঠিক চেকআপের কথা লেখা রয়েছে। ইস একদম মিসফায়ার। এসময় ফোন করাটাও ঠিক হবেনা তাই ব্যাক টু প্যভেলিয়ান।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সাউথ ক্যালকাটার কেয়াতলার বাড়িতে গিয়ে দড়জার কড়া নাড়তেই ব্যোমকেশ নিজে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিল, ' কি সৌভাগ্য আমার, আসুন আসুন, আসতে কোন অসুবিধা হয়নিতো!'
'একদম নয়, গুগল ম্যাপের সাহায্যে চাঁদেও চলে যেতে পারি, কোন গাইড লাগবেনা।'
কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠে,'দারুণ বলেছেন মিঃ জটায়ু, এই জন্যই আপনি সবার প্রিয়।'
সুযোগ বুঝে নিজের ঢাকটা পিটিয়ে বললেন ' এটা বাক্যগুলো আমার লেটেস্ট কাহিনী গ্ল্যামারাস গোয়ালিয়র এ কাজে লাগিয়েছি। পড়েননি নিশ্চয়!' বলেই ব্যাগ থেকে একটা বইয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যোমকেশ কে লিখে সই করে ধরিয়ে দিলেন।
এরপর একটু স্মার্ট হয়ে জিঙ্গেস করলেন ' অজিত কে দেখছিনা, কোথাও বেড়িয়েছেন বুঝি।'
'ঐ প্রকাশনার কাজে ব্যস্ত, কলেজ স্ট্রীট পাড়ার দিকে গেছে। আজকাল আমার দিকে সময় দিতেই পারেনা। সামনে সপ্তাহে মুর্শিদাবাদের কাছে লালগোলা যেতে হবে, দিন ঠিক করতেই পারছিনা।'
'কোন নতুন সত্যান্বেষণ বুঝি!'
'বলতে পারেন, তা আপনি তো এখন ফ্রী, যাবেন নাকি, আপনার রহস্য উপন্যাসের কাজে লাগবে।'
' আর অজিত?'
' না না অজিত তো থাকবেই। আপনাকেও দরকার।'
' আমি, মানে আমার যাওয়াটা কি ঠিক দেখাবে!'
'কেন নয়, ঐযে বললাম পরের উপন্যাস লালগোলায় গোলাগুলি ঐখান থেকেই শুরু হতে পারে।'
প্রস্তাবটায় উৎসাহ নিয়ে একটু নড়েচড়ে সোফাটা গুছিয়ে নিয়ে বসে ' একটু যদি ডিটেল্সে বলেন।'
'দুদিন আগে লালগোলা থানায় ওসি পলাশ ভৌমিকের ফোন আসে, গত ছমাসের মধ্যে ওখানকার এক পরিবারের পরপর তিনজন লোক খুন হয়েছে। অতি সাধারণ পরিবার, দিন আনে দিন খায় অবস্থা। অল্প সল্প জমি জায়গা আছে তবে তার আয় থেকে ছমাসও চলেনা।
খুনের মোটিভ পুলিশের কাছে পরিস্কার নয়। তবে যতদুর জানা গেছে এরা নবাব সিরাজুদ্দোল্লার বংশধর। পূর্বপুরুষদের কেউ নবাবের অতি প্রিয়পাত্র ছিল।'
'নবাবী খাজানা' বলে লালমোহন বাবু দুহাতেই তুড়ি বাজিয়ে উঠলেন। 'ভাবা যায় নবাব সিরাজুদ্দোল্লার সম্পত্তি। আমি রাজি মশাই, এ সুযোগ হাতছাড়া করছিনা।'
'এত সহজ নয় মিঃ জটায়ু। আপনার প্রখর রুদ্রকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।'
'কোই বাত নেহি, হো যায়েগা। আপ ইন্তেকাল কিজিয়ে।'
'ওটা ইন্তেকাল নয় ইন্তেজাম হবে।'
'সহি বাত ইন্তেজাম, সরি।'
ইতিমধ্যে পুটিরাম চা ও গরম সিঙ্গারা দিয়ে গেছে। সিঙ্গারায় কামড় দিতে দিতে আবার জানতে চাইলেন 'কিন্তু অজিত!'
' ওতো থাকবেই, সঙ্গে আপনিও, আগামী রবিবার আমরা রওনা দিচ্ছি।'
'বলছেন, তবে ওখানকার প্লট নিয়ে লিখলে আপনার দেওয়া নামটাই দেবো, লালগোলায় গোলাগুলি।'
এরপর আরও দুচার কথার মাঝেই অজিত হাজির। কিছুক্ষণ আলোচনা করার পর অজিত মন্তব্য করে বসলো 'তাহলে জটায়ুর দলবদল।'
লালমোহন বাবু কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। ব্যোমকেশ কোনরকমে ম্যানেজ করে ' না না ওভাবে কেন ভাবছো অজিত, উনি ওনার লেখার রসদ জোগাড় করতে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। বলতে পারো অজিত তোমাকেই কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে।'
'না না কিযে বলেন এতদিনে আবার প্রতিযোগিতা।'
অজিত ও লালমোহন বাবু দুজনেই হো হো করে হেসে ব্যাপারটা মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষটা কি হয় কে জানে। লালমোহন বাবু আর কথা না বড়িয়ে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বলে 'অনেকক্ষণ হলো এবার তাহলে ওঠা যাক, আগামী রবিবার লালগোলা এক্সপ্রেস।'
ফেলুবাবুর অনুপ্রেরণায় প্রাণায়ামের যে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে সেই মতো পরেরদিন সকালে দুএকটা ফোঁসফাঁস শুরু করেছে আর তখনই ফোনটা বেজে উঠল। ওপার থেকে ফেলুবাবুর তীক্ষ্ণ গলা, 'সুপ্রভাত লালমোহন বাবু, প্রাণায়াম হয়ে গেছে আশাকরি।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ, সুপ্রভাত।'
'তাড়াতাড়ি চলে আসুন, কথা আছে।'
' ইয়ে, আপনার শরীর ঠিক আছেতো!'
'একদম ফিট,তাড়াতাড়ি আসুন,এখানেই জলখাবার।'
ফোনটা কেটে যাওয়ার পর নিজের মনেই বলে উঠলো 'হাইলি সাসপিসিয়াস।' ঝটপট চা খেয়ে রেডি হয়ে ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করছে। আধঘণ্টা পর ড্রাইভার এলে আর সময় নষ্ট না করে রওনা ফেলুবাবুর বাড়ি। বেল টিপে ভেতরে ঢুকে কাউকে দেখতে না পেলেও সোফায় নির্দিষ্ট জায়গায় বসতেই তিন চার মিনিটের মধ্যেই জলখাবার এসে গেল, সাথে সাথে ফেলুবাবুর প্রবেশ।
জলখাবার খেতে খেতে বলে 'কাল এসে আপনাকে পাইনি, চেকআপে গিয়েছিলেন।'
'ফোন করলেই পারতেন তাহলে হয়রানি হতোনা।'
' না না ঠিক আছে। আপনার নেক্সট প্রোগ্রাম ? নিশ্চয় এখন নতুন কোন অ্যাসাইনমেন্ট নেবেন না!'
'যা ভাবছেন তা নয়। সামনে সপ্তাহে ভোপাল যেতে হবে। ওখানকার ভীম ভেটকার গুহা গুলোতে কিছু অস্বাভাবিক কাজকর্ম হচ্ছে। আর্কিয়লজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন এসেছিল, রহস্য হাজির।'
কথাটা শুনে একটু হতাশ হয়ে সোফায় টাইট হয়ে বললেন,'সামনে সপ্তাহে'!
' হ্যাঁ আপনিও যাচ্ছেন স্যার, অনেক দিন বাইরে যাওয়া হয়নি, অসুবিধা আছে?'
এরপর আর ভূমিকা না করে ফেলুদা সরাসরি অ্যাটাক করে, 'কাল সন্ধ্যায় কেয়াতলা গেছিলেন, ব্যোমকেশ বক্সীর কাছে।'
কথাটা শুনে এতটাই চমকে গেলেন যে সন্দেশের অর্ধেকটা মুখে থেকে জামাকাপড়ে পড়ল আর বাকিটা গলায় লেগে বিষম খেতে শুরু করলেন।
'অত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন, জল খান।'
চোঁ চোঁ করে গ্লাসের জলটা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন ,
'আমি কিন্তু এব্যাপারে আপনার অ্যাডভাইস নিতেই এসেছিলাম, নেহাতই..। আপনি কি করে জানলেন মশাই।'
'মগজাস্ত্র'।
'তবুও এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন করা যাবে ?'
'যাবে।'
' আমার গতিবিধির দিকে কেউ কি নজর রাখছে?'
' লালমোহন বাবু আপনার প্রখর রুদ্রকে টেকনোলজি সম্বন্ধে আরও একটু তৈরী করে তুলুন নাহলে সবই সেই কেনিয়ার হায়নার মতো ফাঁস হয়ে যাবে। তপসের কাছে আপনি গুগল ম্যাপ শিখে নিয়ে তা ব্যবহার করে অনেক কিছু সুবিধা পাচ্ছেন তবে অসুবিধেও অনেক।'
' এ ব্যাপারে তপেশের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, ওর একটা ট্রীট পাওনা আছে।'
'গুগল ম্যাপে লোকেশন শেয়ারিং অন করে সময়মতো অফ করতে হবেতো, নাহলে সবাই তো জানবেই।'
'অসুবিধে গুলো থেকে বেড়িয়ে আসা কি সম্ভব?'
'অবশ্যই।'
'তাহলেতো তপেশ রঞ্জনের কাছে আর একটা সিটিং করতে হবে। '
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকার পর লালমোহন বাবুই বললেন,
'হলো না।'
' কি, জটায়ুর দলবদল?'
' হুম, যত তাড়াতাড়ি হয় ব্যোমকেশ বাবুকে সব বলতে হবে। ফেলুবাবু আপনি আমার টিকিটের ব্যবস্থা করুন। সামনে ভোপাল।'
আর কথা না বাড়িয়ে লালমোহন তার ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বললেন।
Comments
Post a Comment