হাতের কাজটা মোটামুটি শেষ করে সবে লাঞ্চ বক্সটা খূলে দু এক দিয়েছি আর অফিসের ফোনটা বেজে উঠলো। বেশ কয়েক বছর আগের কথা, আজকের মতো তখনও হাতে হাতে মোবাইল হয়নি অফিসের ল্যান্ডলাইনই ছিল যোগাযোগের ভরসা। ফোনের ওপারে থেকে এমনই এক দুঃসংবাদ ভেসে এলো যা কোনদিন কল্পনাও করিনি।
' আমি কুলতলি থেকে তমাল বলছি, ইয়ে মানে খুবই খারাপ একটা খবর আছে।' বিবেক আমার এক আত্মীয় কুলতলিতে থাকে।
' হ্যাঁ ব'ল, কি এমন দুঃসংবাদ?'
' তোমাদের ছোটকাকু খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা ভালো নয়। তোমরা এক্ষনি চলে এসো।'
ঘোর কাটতে কয়েক মুহুর্ত লাগল, 'ঠিক আছে এক্ষুনি আসছি' বলে ফোনটা কেটে দিলাম। তাড়াতাড়ি অফিসে জানিয়ে বাড়ি এলাম।
আমার স্ত্রী ও আমার মাকে খবরটা দিয়ে রেডি করে সবাইকে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। ছোটকাকা বয়সে আমার থেকে তিন চার বছরের বড়, দুজনেই প্রায় বন্ধুর মতো মেলামেশা করতাম। আজকাল যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত থাকায় যোগাযোগটা কমেই গেছিল। কিন্তু এই রকম একটা খবর পেয়ে মনটা খুব উতলা হয়ে গেল। মায়েরও প্রায় ছেলের মতো ছিল, খুবই কান্নাকাটি করতে শুরু করেছে। কতরকম ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বছর খানেক আগেই একটা স্ট্রোকের মতো হয়েছিল, সেটা অবশ্য বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি অসুধ বিসুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছিল তবে পা টা একটু টেনেটেনে হাটতো। সেটাই কি আবার বাড়াবাড়ি ধরনের কিছু হলো। কি হবে ওর ছেলেটাওতো এখনো চাকরি বাকরি করেনা, তেমন কিছু হলে কি যে হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে কুলতলি হাসপাতালের গেটে পৌঁছে গেছি। খুব বেশি দুরে না হলেও প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়ে দেখি সেই মুহুর্তেই একটা স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হচ্ছে, মুখটা ঢাকা। বুঝতেই পারলাম বড়ো কিছু অঘটন ঘটে গেছে। মুখের কাপড় সরিয়ে দেখা গেল গলায় কালো দাগ, গলায় দড়ি দিয়ে মৃত্যুর চিহ্ন স্পষ্ট। এখন পাড়ার বেশ কজন ছেলে পোষ্টমর্টেম করতে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের যেতে দিলনা।
কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও পাড়ার লোক নিয়ে গাড়িটা চলে গেল। আমরা কাকার বাসায় ফিরে এলাম, এসেই দেখতে পেলাম বারান্দায় লোহার এঙ্গেলে একটা দড়ি ঝুলছে। মাঝখানে ছুড়ি দিয়ে কাটা , ছুড়িটাও পাশের টেবিলে রাখা আছে। ঐ বারান্দাতেই কাকা শুতো ও প্রায় সারাদিন কাটতো। একটা মাঝারি মাপের চৌকি তার ওপর একটা ছোট টুল এখনো রাখা আছে যেটার ওপরে উঠে নাকি ঐ দড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। আমার কিন্তু সন্দেহ হতে লাগলো, যে কাকা পা টেনে টেনে হাঁটত সে ঐ চৌকি তার ওপরে টুল, সেখানে দাঁড়িয়ে কিভাবে গলায় ফাঁস দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ভেতরের ঘরে খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে কাকিমা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। ১৯/২০ বছরের ছেলে সদ্য পিতৃহারা হয়ে মায়ের কাছেই চুপচাপ বসে আছে। এরই মাঝে অনেক আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এসে গেছে। আমার মতো অনেকের মধ্যেই সন্দেহের দানা বেঁধেছে। নানাভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছে জবাবে কিছু অসংলগ্ন ও বানানো উত্তর দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বলহরি হরিবোল দিতে দিতে পোষ্টমর্টেম ও অন্যান্য কাজ সেরে গাড়ি এসে ঢুকলো। আর এক প্রস্থ কান্নাকাটি সেরে মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমিও আমার গাড়িতে কয়েকজনকে তুলে নিয়ে শ্মশান যাত্রী হলাম। কাকার শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয় প্রায় রোজই আসত তাকে দেখতে না পেয়ে জানতে পারলাম শরীর ও মন দুইই খারাপ তাই আসেনি।
এরপর যথারীতি শব দাহ করে কাকার বাসায় ফিরে এলাম। শ্মশান যাত্রীদের কিছু নিয়ম কানুন থাকে সেগুলো পালন করে ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে যাই। মধ্য রাত্রি পেরিয়ে গেছে, অনেকেই নিষেধ করলেন এত রাতে না গিয়ে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো। আমিই একটু জোর করেই ফিরে আসার জন্য মনস্থির করে বেরিয়ে পড়লাম।মনের মধ্যে একটা চাপা দুঃখ নিয়ে চলেছি, সাত পাঁচ ভাবছি। আমাদের দুজনের ছেলেবেলার কথা, কত স্মৃতি, কত ভালোমন্দ মেশানো দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে নিকষ কালো অন্ধকার পেরিয়ে মাঝরাতে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুটা যাওয়ার পর দেখি আকাশ কালো করে মেঘ আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। ক্ষণপ্রভা প্রভা দানে বাড়ায় মাত্র আঁধার.....। বিদ্যুতের ঝলক আর তারপরই মেঘের গর্জন তারসঙ্গে সহযাত্রীদের আতঙ্ক এই নিয়েই আরও মিনিট দশেক পেরবার পর তুমূল বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। মা ও স্ত্রী দুজনেই বলতে শুরু করেছে না বেরলেই ভালো হতো। কোথাও যেন একটু দাঁড়াই, কিন্তু এত রাতে আর এই দূর্যোগে সে সাহস করতে পারলাম না।
এত বৃষ্টি কোথায় ছিল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাস্তায় জল জমে গেছে। গাড়ির সামনের উইন্ডস্ক্রীনে এত জল বইছে ওয়াইপার দিয়েও বৃষ্টির জল কাটছেনা। গাড়ি জোরে চালাতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে। ঘষঘষ করে দুটো ওয়াইপার অবিরত সর্বাধিক গতিতে ওঠানামা করেও কিছু করতে পারছেনা। তারপর রাস্তায় জল জমে খানাখন্দ কিছুই বুঝতে পারছিনা। বৃষ্টির বেগ ও মেঘের ঝলকানি এই ভাবে চলছে।
হঠাৎই দেখলাম উইন্ডস্ক্রীনটা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। কেউ যেন গাড়ির ছাদ থেকে দুটো লম্বাহাত দিয়ে কাঁচের উপরে লেগে থাকা জলগুলোকে মুছে দিচ্ছে। তারই মাঝে বিদ্যুতের ঝলকে পরিষ্কার দেখতে পেলাম ছোটকাকার মাথা ও মুখের কিছুটা অংশ। গাড়ির ছাদের উপর শুয়ে মাথাটা বের করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে কাঁচটাকে পরিষ্কার রাখার। এরপর পরিস্কার কাঁচটার সামনে দিয়ে দেখতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। এই ভাবেই এগিয়ে চলেছি আর ঐ হাত দুটো তখনও কাঁচটা পরিষ্কার করে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই চলার পর ঘোর কাটলো সত্যিই কি ছোটকাকা এসে এইরকম করছিল!
আরও কিছুটা যাওয়ার পর বৃষ্টি অনেকটাই ধরেছে। এখন টিপটিপ করে পড়ছে বা নেই বললেই চলে। রাস্তার ধারে একটা পরিষ্কার জায়গায় লাইটপোষ্টের নিচে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে গাড়ির ছাদের উপরটা ভালো করে দেখলাম, কই কোথাও কিছু নেই। স্ত্রী ও মা দুজনেই একসঙ্গে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
' কি হলো নামতে গেলে কেন, কোন গোলমাল?'
গাড়ি থেকে নেমে ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগলো। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অষ্পষ্ট গলায় বললাম
' না কিছু নয়, এমনি।' তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট করে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
Comments
Post a Comment