ডুয়ার্সের ডায়েরী
পর্ব-১
এর আগে দার্জিলিং যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করেও নানা কারণে সম্ভব হয়নি। তাই এবার দার্জিলিংএর আশপাশে একটু নিরিবিলি স্থানে শান্ত পরিবেশে প্রকৃতির সৌন্দর্যতা স্বাদ নেওয়াই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য।
NJP স্টেশন থেকে আগে থেকে গাড়িতে ভোরে শুরু হলো যাত্রা 44 কিমি দুরে লাটপানচার। সকালে ঘন কুয়াশা কিছুটা নিরাশ করে দিলো। সিকিম হাইওয়ে ধরে কালিঝোরা থেকে বাঁক নিয়ে চড়াই ও ততোধিক খারাপ 13 কিমি রাস্তা শুরু হলো। 8টার সময় পৌঁছলাম পদম গুরুং এর হোম স্টে।
হার হিম করা ঠান্ডায় গরম চায়ের উষ্ণ অভ্যর্থনার পর একটু বিশ্রাম করে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। পায়ে পায়ে এগোলাম 2 কিমি দুরে সরসরি ধারার দিকে, যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্গা ভালো দেখা যায়। রাস্তা ভালো হলেও চড়াই উৎরাইএ অসুবিধে হচ্ছিলো। কিন্তু কুয়াশা আরও ঘন হওয়ায় শেষ পর্যন্ত না গিয়ে ফিরে এলাম। বিকেলে গাড়ি ভাড়া নিয়ে মহানন্দা জঙ্গল সাফারি। ঘন জঙ্গলে হাতির দল বেরনোয় বেশি ভেতরে যাওয়া সম্ভব হলোনা। কিন্তু নতুন অভিজ্ঞতা হলো সিঙ্কনা গাছের ঘন জঙ্গল দেখে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন তৈরীতে একসময় এই গাছের খুব চাহিদা থাকলেও আজ প্রয়োজন কমে এসেছে, তাই এখন লাভজনক না হলেও কোনরকমে এই প্রকল্প চলছে।
পরদিন ছিলো ভোর ছটায় বার্ড স্যঙ্গচুয়ারি দর্শন। নানা ধরনের প্রায় দুশতাধিক পাখি এই এলাকায় দেখা যায়। অতো না পেলেও আমরা নিরাশ হইনি। বিশেষ করে Rufous necked Hornbill, Blue whistling thrush, Grey wing black bird, Black crested bulbul, Orange bellied leaf bird ও আরো কত নাম না জানা পাখি অন্যতম। এরপরে আমাদের গন্তব্য অহলধারা view point যেখান থেকে খোলা আকাশের নিচে একাধিক সবুজ পাহাড় ও চাবাগানের দৃশ্য অবর্ণনীয়, কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকায় কাঞ্চনজঙ্গার দেখা পাইনি। ফেরার পথে নামদিন লেক দর্শন , লেকে এইসময় জল না থাকায় সালামান্ডার দেখা সম্ভব হয়নি।
এর পরদিন তিনচুলে যাত্রা। (ক্রমশঃ)
পর্ব- ২
দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা 50 কিমি দুরে তিনচুলে অভিরাজ হোম স্টে। কালিঝোরার দূর্গম রাস্তা এরিয়ে সেল্পু হয়ে ঘন শাল বনের ভেতর দিয়ে NH10 ধরলাম। একটু এগিয়ে তিস্তার ধার দিয়ে অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাওয়া। এরপর শুরু হলো দার্জিলিং যাওয়ার চড়াই । প্রথম স্টপেজ লাভার্স ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে পাহারের নিচে তিস্তা ও রঙ্গীত নদীর সঙ্গম স্থল, মনোরম এই দৃশ্যের আবেশ অনেকদিন মনে রাখার মতো। কিছুক্ষন পর আবার যাত্রা শুরু। পেশক মোড়ে এসে বাঁদিকের চড়াই রাস্তা ধরে পেশক চাবাগানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। 5 কিমি রাস্তা খুবই খারাপ, চাবাগান বন্ধ তাই রাস্তার এই হাল। খানিকটা এগিয়েই থামলাম বাঁদিকে অভিরাজ হোমস্টে আর ডানদিকে পাইনের ঘন জঙ্গল। চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে বেড়লাম। রাস্তার দুধারে আকাশ ছোঁয়া পাইনের ঘন অন্ধকার জঙ্গল এতই গভীর সূর্যের আলো পর্যন্ত্য ঢুকতে পারেনা। খুবই নিরিবিলি গা ছমছম করা পরিবেশ, নানা পাখির কিচিমিচি শব্দ আর মাঝে মাঝে একদুটো গাড়ী যাওয়ার শব্দ, এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। দুপুরের খাওয়া সেরে মেঘলা আকাশ আর প্রকৃতির শান্ত পরিবেশ দেখতে দেখতে কখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো বুঝতেই পারিনি।
পরের দিন গাড়ী নিয়ে যাই টাডকা অর্কিড সেন্টার, প্রাচীন মনেস্ট্রী আর বড়মাঙ্গয়ার ফার্ম হাউস। ফার্মের একজন আমাদের ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল এই সাজানো বাগান। বিগ ফার্ণ, রুদ্রাক্ষ, তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, রনডেনড্রন, কমলালেবু, পাহাড়ী কারি পাতা , গোলাপজাম, কফিগাছ, একাধিক সুন্দর সুন্দর ফুল ও আরও কয়েক শত নানারকম গাছ গাছালি দেখে ওখানকার ফ্যাক্টরী দেখে কিছু জ্যাম জেলী আচার ও কমলাখোষার পাউডার ইত্যাদি কিনে ফিরে আসা।
পরদিন সাড়ে পাঁচটায় ভোররাতে দেখি সারা আকাশ লাল হয়ে গেছে। কাল রাতে আকাশভর্তি তারা দেখে সবাই বলেছিল আজ আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি উঠে খোলা ছাদে দেখি এক মোহময় দৃশ্য যা প্রত্যক্ষ করার জন্য বহুদূর থেকে মানুষ জড়ো হয়। সোনালী রঙ্গে সেজে একটু একটু করে জেগে উঠছে কান্চনজঙ্ঘা, ক্রমে হিমালয়ের অন্য চূড়াগুলোও জেগে উঠেছে।সব মিলিয়ে তৈরী হয়েছে ঘুমন্ত বুদ্ধ বা sleeping Buddha, বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি হিমালয়ের শোভার দিকে। ধীরে ধীরে সোনালী আভা কাটিয়ে রজতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্য চূড়াগুলো দৃশ্যমান হয়ে এক অলৌকিক পরিস্থিতি তৈরী করেছে। এইভাবেই প্রায় নটা বেজে গেল, আর অপেক্ষা করা চলবেনা।ড্রাইভার তাগাদা দিচ্ছে আজ আমাদের একদিনের দার্জিলিং সফর। (ক্রমশঃ)
পর্ব- ৩
যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্তুত হয়ে 27 কিমি দূরে দার্জিলিংএর উদ্দেশে রওনা দিলাম। চাবগানের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা পেরিয়ে নামলাম পেশকরোডে, 7 কিমি দুরে প্রথম স্টপেজ লামাহাট্টা। রাস্তার ধারে টাকডা ফরেস্টের এক প্রান্তকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরী হয়েছে পার্ক। খানিক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল । বেঁকে বেঁকে চড়াই রাস্তা, পাশ ফিরতেই দেখি কাঞ্চনজঙ্গা এখনও আমাদের সামনে প্রকট হয়ে আছে আর দেখা যাচ্ছে ঘন বসতিপূর্ণ দার্জিলিং পাহাড়। ছবি তোলার জন্য একটা ফাঁকা জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো।
আরও কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে হিল কার্ট রোড ধরে পৌঁছলাম ঘুম। আগের চেনা জানা শান্ত ঘুমন্ত ঘুম পেলামনা। এখন জনবহুল ব্যাস্ত ঘুম,কংক্রিট আর যান চলাচলের আধুনিকতার স্পর্শ সর্বত্র। ঘুম মনেস্ট্রী থেকে ফেরার পরেই শুনতে পেলাম রেল ইন্জিনের শব্দ। চকিত ফিরতেই দেখি দুটো বগি নিয়ে নিজের পুরনো ছন্দে এগিয়ে আসছে 1891 থেকে চলে আসা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়া (DHR) দার্জিলিং এর টয় ট্রেন। অসীম আনন্দ নিয়ে বিহ্বল হয়ে দেখলাম, কিছুক্ষণ পরেই আর একটা ট্রেন। মনের মতো কয়েকটা ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললাম বাতাসিয়া লুপ। এক অসাধারণ সুন্দর জায়গা, চারিদিকে সবুজ পাহাড় আর অজস্র ছোট ছোট বাড়ী। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আবার সেই ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে এল সেই ট্রেন, তারপর পাকদন্ডি ঘুরে চলে গেলো। এটা না পেলে বাতাসিয়া লুপ দেখা অপূর্ণই থেকে যেতো। এরপর চাবাগান পরিদর্শন যেখান থেকে লেবং রেসকোর্স দেখা যায়।এরপর রাস্তায় পড়লো রোপওয়ে স্টেশন। আমরা না চড়লেও বেশ কিছুক্ষণ এর যাতয়াত উপভোগ করে এগিয়ে চললাম পদ্মজা নাইডু হিমলয়ান জুলজিক্যাল পার্ক (Zoo) ও হিমালয়ান মাউটেনিয়ার্স ইনস্টিউট (HMI). ঢোকার টিকিট 50 টাকা ও ক্যামেরার 10 টাকা। ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন পশুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য Samber, Blue ship, Braking deer, Yak, Blue sheep, Royal Bengal Tiger, Tibetan wolf, Snow leopard, Black leopard ইত্যাদি ও নানারকম পাখি। এরই মাঝে HMI মিউজিয়াম দর্শণ। হিমালয়ে মাউন্টেনিং এর বিভিন্ন সামগ্রী, মূল্যবান ছবি ও হিমালয়ের নানা পশুপাখির আসল চেহারা দেখে রোমাঞ্চিত হতে হয়। পরের স্থান ঐতিহ্যবাহি দার্জিলিং ম্যাল। সময় পাল্টালেও এই জায়গার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। শতাধিক মানুষের সাথে ঘোরাঘুরি মাঝে অল্পবিস্তর কেনাকাটা ও কিছু খাওয়াদাওয়া করে আড়াই তিন ঘন্টা কেটে গেছে। পাহাড়ী রাস্তা ফেরার তাগাদা আছে তাই ড্রাইভারের খোঁজ করে তিনচুলে প্রত্যাগমন। আগামীকাল সকালে আমাদের গন্তব্য কার্শিয়াং। (ক্রমশঃ)
পর্ব- ৪ (শেষ পর্ব)
শেষ পর্বের যাত্রা তিনচুলে থেকে কার্শিয়াং। 44 কিমি , দু ঘন্টা পর বারটায় কার্শিয়াং টুরিস্ট লজ পৌঁছলাম। প্রথম দিনটা কার্শিয়াং এর ছোট্ট জিলেবী বাজার ঘুরে লজেই বিশ্রাম করে কাটিয়ে দিলাম।পরদিন ভোরে আরও সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলো। প্রায় ঘন্টখানেক অপেক্ষা করে এক এক করে প্রকট হচ্ছে সোনালী রঙের সব চূড়া, তারপর পরিষ্কার হলো স্লিপিং বুদ্ধ।
ব্রেকফাস্ট করে তৈরী হয়ে বেরলাম বিভিন্ন দ্রস্টব্য স্থান। কার্শিয়াং স্টেশনের পাশ দিয়ে খানিকটা ওপরে গিড্ডা পাহাড় ,এখান থেকে কার্শিয়াং শহরটা ছবির মতো লাগে। কছেই নেতাজী সুভাষের স্মৃতিজড়িত মিউজিয়াম। যদিও মেরামতির কাজ চলছে , অগোছাল অবস্থাতেই ওখানের কেয়ার টেকার পদম ছেত্রী সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালো আর নেতাজী ও তাঁর পরিবারের অনেক মূল্যবান তথ্য জানিয়ে আমাদের আগ্ৰহ পূর্ণ করলো। অসুস্থ হয়ে নেতাজী এখানে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েও যান। তাঁদের ব্যাবহৃত খাট , টেবিল, চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র দেখে আবেগ প্রবণ হতে হয়। এছাড়াও নিজের স্ত্রী কন্যা,পরিবার ও অন্যান্য বিশেষ ব্যাক্তি যেমন হিটলার,গান্ধিজি, নেহরু,রবীঠাকুর ইত্যাদির সাথে ছবি ও চিঠিপত্রর সংগ্ৰহ উল্লেখযোগ্য।
এরপরের দ্রস্টব্য ইগল ভিউ পয়েন্ট।সেখান থেকে গোটা কার্শিয়াং ও অন্যান্য পাহাড়ের সৌন্দর্য অতুলনীয়। এবার আমরা উঠতে শুরু করলাম ডাউ হিল। পাইন গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বাঁকা রাস্তা দিয়ে ওপরে ডাউহিল ডিয়ার পার্ক, ডাউহিল স্কুল দেখে ঐ সরু রাস্তা দিয়ে নেমে এলাম। খাওয়া সেরে আজকের মতো বিশ্রাম। কাল ফেরার পালা।
ব্রেকফাষ্ট সেরে একবেলা বিশ্রাম। লাঞ্চের পর দুটো নাগাদ ফেরা শুরু। পাঙ্খাবাড়ি রোড দিয়ে য়াওয়ার সময় মকাইবাড়ী টি এস্টেট, চা পাতার অভাবে কারখানায় প্রসেসিং বন্ধ তবুও অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেখে বুঝে বহুদিনের ইচ্ছে কিছুটা প্রশমিত করলাম। নানা দামের কিছু চা পাতা কিনে নিচে নামতে শুরু হলো। ধিরে ধিরে পাহাড় শেষ করে সমতলে নেমে এসে মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মাঝে লংভিউ চাবাগানে নেমে ঘুরে দেখা হলো, সুন্দর করে ছাঁটা ঘন সবুজ বাগান দেখে মন ভরে গেলো। ফেরার পথে শিলিগুড়িতে হংকং মার্কেটে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার সেই NJP স্টেশন।
কিছু পরেই পদাতিক এক্সপ্রেস ছাড়বে গত নদিনে ব্যস্ত সফরের শেষ। অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার ভ্রমন। বিবরনের প্রচেষ্টা যারা পড়লেন তাদের ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment