Skip to main content

স্বপ্নে তোলা ছবি  

                        
  স্বপ্নে তোলা ছবি  
 
    চাকরি থেকে অবসরের পর প্রথম প্রথম চিন্তা হতো কি করবো সারাদিন কিকরে সময় কাটবে। শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপদেশ দিল ঘুরে বেড়ান। উপদেশটা বেশ মনঃপুত লাগলো। এর আগে নানা কারণে বেড়ানো আমাদের খুব একটা হয়ে ওঠেনি। এবার তাহলে সময় করে বেড়িয়ে পড়া যাবে। " দেখবো এবার জগৎ টাকে, কেমন ঘুড়ছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে..…"। প্রথমেই একটা মাঝামাঝি রকমের DSLR ক‍্যামেরা কিনে ফেললাম। ছবি তোলার সখ বহুদিনের।পুরনো রীল ভরা অটোমেটিক ক‍্যামেরা তার কৌলীন‍্য হারিয়েছে। তাই পু্রনো ক‍্যামেরার মায়া ত‍্যাগ করতেই হলো। এখন সব ডিজিটাল যুগ।ডিজিটাল ঘড়ি,ডিজিটাল ব‍্যংক, ডিজিটাল ইন্ডিয়া।
          যাইহোক তল্পিতল্পা বেঁধে, কাঁধে ক‍্যামেরার ব‍্যাগ ঝুলিয়ে আমার জীবন সঙ্গীনির সাথে বেড়িয়ে পড়লাম। কখনো প্রতিবেশী, কখনো আত্মীয়, কখনো ট্যুর কম্পানি, কখনো বন্ধুদের সাথে বেড়ানো চলছে। চড়ৈবেতি চড়ৈবেতি। পাহাড় সমুদ্র জঙ্গল মন্দির মসজিদ আরও কত কি। শুধু বেড়ানোইতো নয় সঙ্গে ছবি তোলা। যেখানে যা ফটোগ্ৰাফিক মেটিরিয়াল পাচ্ছি লেন্সবন্দী করে স্মৃতির ভান্ডার ভরিয়ে তুলছি। একবার করে একটা জায়গা বেড়িয়ে আসছি রোমাঞ্চিত হচ্ছি আর ছবি গুলো ক‍্যামেরা থেকে কম্পিউটারে ট্রান্সফার করে দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেলে আবার আর একটা নতুন জায়গার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাচ্ছে।
          পাহাড় সমুদ্র জঙ্গল মন্দির মসজিদ কতো জায়গা ঘুরে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে। তবে এগুলোর মধ্যে জঙ্গল‌ই বেশি আকর্ষিত করে। খোলা আকাশের নিচে ঘন জঙ্গলের ফাঁকে আলো আঁধারের মাঝে হাতি, গন্ডার, হরিণ, সম্বর, ভাল্লুক আরও কত কি। এ ছাড়াও আছে নানা প্রজাতির পাখি। গভীর জঙ্গলের মধ্যে  ঢুকে এই সব জন্তু জানোয়ারের দেখা পাওয়া। কোনখানে রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল হাতি, যতক্ষণ না তার ইচ্ছে হচ্ছে আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার কোথাও রাস্তার ধারে ঘন ঘাসের ঝোপে গন্ডার তার বাচ্চা নিজের আনন্দে ঘাস খেয়ে চলেছে আর তাদের শরীরের পোঁকা খাওয়ার জন্য বকগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও আবার দু তিনটে ভাল্লুক মড়ে পড়ে থাকা সম্বরের মাংসের জন্য মারামারি করছে। শুধু নিজের চোখে দেখা নয় ছবি তোলার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। নানা কোন থেকে নানা রকম ছবি তুলেই চলেছি। পরে সেই ছবি গুলোই কত গল্পের সৃষ্টি করে, কতো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
            একবার ডুয়ার্সের চাপড়ামারী জঙ্গলে বিকেলের দিকে গেছি।  ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জীপ সঙ্গে আর্মড গার্ড।ওয়াচটাওয়ার থেকে জানোয়ার দেখার জন‍্য উঠে  গভীর আগ্ৰহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। কোথায় কি, কোন রকমের জানোয়ারের দেখা পেলামনা। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে গেছে। জীপের ড্রাইভার ও গাইড দুজনেই ভরসা দিয়ে বলে 'হতাশ হবেন না এইরকম হালকা অন্ধকারে ফেরার পথে ঠিক দেখা পাবেন।'
           অগত্যা জীপে উঠে বসলাম। আমার স্ত্রী প্রতিবেশীনীর সঙ্গে
মাঝের সীটে বসলো যাতে সামনের দিকে ভালো ভাবে দেখা যায়। আমি,আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক ও গাইড পেছনের দিকে বসেছি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ড্রাইভার হঠাৎই গাড়ী থামিয়ে আস্তে আস্তে ডানদিকে দেখতে বলে। আমরাও কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখি গাছের ফাঁকে বেশ কতকগুলো আলো জ্বলজ্বল করছে। দৃষ্টিটা স্থির করে বুঝতে পারি প্রায় কুড়িটা বাইসন দাঁড়িয়ে আছে। মোজা পড়ে থাকার মতো সাদা সাদা পা, কালো মিশমিশে গা আর জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ গুলো যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু দুরেই ঐ অন্ধকারের মধ‍্যেও কয়েকটি হাতি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ এইসব আনন্দ উপভোগ করার পর আবার  এগোতে থাকলাম। হঠাৎই ড্রাইভার বলে উঠলো 'ঐ দেখুন বাঘ পেড়িয়ে গেল'। আমার স্ত্রী ও অপরজনও বলে ' আমরাও দেখতে পেলাম রাস্তা পার হয়ে ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেল।' সম্বিত ফেরার আগেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সবচাইতে বড় কৌতূহল। আমরা উল্টোদিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই কয়েক মুহুর্তের জন্য দেরী হয়ে গেল। আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকলোনা।
           এরপর আরো অনেক জঙ্গল সাফারী করেছি আরো অনেক জন্তু জানোয়ার নানারকম পাখির দেখা পেয়েছি , ভালো ভালো ছবিও তুলতে পেরেছি। অনেক ছবি বিভিন্ন পত্রিকায়, প্রদর্শনীতে নানা ভাবে প্রশংসাও অর্জন করেছে। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য কোথাও বাঘের দেখা পাইনি। "পায়ে পড়ি বাঘমামা.....কর নাকো রাগ মামা।" সেই বাঘ দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। হাল ছেড়ে দিইনি এখনো। এখনো সুযোগ হলেই জঙ্গল সাফারি করছি আর বাঘ মামার দর্শনের অপেক্ষা করছি।
           যে বহুতলের আবাসনের আমি থাকি তার পাশ দিয়ে একটা ছোট নদী বয়ে গেছে। নদীর ধার বরাবর হালকা ঝোপঝাড় যেটা গিয়ে মিশেছে বাঁকুড়ার জঙ্গলে।  দুএকদিন হলো কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছি কাছাকাছি এলাকায় নাকি একটা বাঘের আনাগোনার টের পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পায়ের ছাপের খোঁজ‌ও পেয়েছে। নেহাতই গুজব বলে মনে হলেও আশঙ্কা একদম উড়িয়ে দিতে পারছিনা। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পড়ন্ত দুপুরে চোখ লেগেছে টের পাইনি। হঠাৎই বাইরের চিৎকারে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। বাইরের ব‍্যালকনিতে এসে শুনতে পেলাম একটু আগেই আমাদের  আবাসনের মধ‍্যেই নাকি বাঘটাকে দেখা গেছে। "লাঠি লেআও, বন্ধুক লেআও... ...লাওতো বটে, কিন্তু আনছেটা কে?"
         বেশি কথা না বাড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। যদিও আমরা পাঁচতলার ওপরে থাকি তবুও সন্দেহ হয় বাঘটা যদি এতটা লাফিয়ে আক্রমন করে তখন কি হবে।   এসব ব‍্যাপারে আমার গিন্নির সাবধানতা আরও একটু বেশি। বাইরের গ্ৰীলগুলোও সব বন্ধ করে দিল , সাবধানের মার নেই। এত কোলাহলের মধ্যেই আসল কেলোটি হলো বাঘটা ঘোড়াঘুড়ি করতে করতে আমাদের টাওয়ারের নিচে  এসেই বসে আছে। বিস্ময় ও আনন্দে আমি আত্মহারা। এবার কার‌ও বারণের তোয়াক্কা না করেই ব‍্যালকনিতে যাই, গ্ৰীলের ভেতর থেকেই পরিস্কার দেখতে পেলাম মোটামোটা দুটো চোখ নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে লেজ নাড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু গা ঝাড়া দিচ্ছে মনে হয় এই বুঝি বা এক লাফ মারে। এপাশের ওপাশের ফ্ল্যাট থেকেও কারো গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে না, তবে কৌতূহল বশত কেউ জানালায় কেউ ব‍্যালকনিতে এসে বাঘের দেখার সাক্ষী হতে চাইছে। আর আমিও নিজেকে নিশ্চিত ভাগ‍্যবান ভাবছি। অধিক উত্তেজনায় ক‍্যামেরা বার করতেই ভুলে গেছি। তাড়াতাড়ি ক‍্যামেরা নিয়ে এসে ফটো তোলার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই ঠিকমতো ফোকাস করতে পারছিনা। এতদিন ধরে যে ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করে আছি ঠিক সময়ে এসে এমন কেন হচ্ছে! রাগে দুঃখে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। নিজের মনের মধ্যে বারবার বলছি এমন কেনো হচ্ছে । কেন ছবি তুলতে পারছিনা।
          'কিগো কি হলো তোমার, এতো বকবক করছ কেন। স্বপ্ন দেখছো নাকি?' ধাক্কা দিয়ে গিন্নি উঠিয়ে দিলো। খানিক্ষণ স্থির থাকার পর বলি হ‍্যাঁ স্বপ্ন‌ই দেখছিলাম।  তবে এই সপ্ন দেখার ফাঁকে একটা খুব বড় জিনিস উপলব্ধি হলো 'স্বপ্নের ছবি তোলা যায়না, এটা শুধু নিজের অন্তরের মধ্যেই রাখতে হয়। লেন্স দিয়ে ফ্রেমবন্দি হয়না।'
           

Comments

Popular posts from this blog

বাঁকুড়ার টেরাকোটা

                                                                বাঁকুড়ার টেরাকোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা  ভারতের শিল্পকর্মের এক বিশেষ স্থান   অধিকার করে আছে।  বাঁকুড়ার  পোড়ামাটির  ঘোড়া ও হাতি নির্মাণের  প্রধান শিল্প  কেন্দ্র গুলি   হল পাঁচমুড়া,  রাজাগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর।  প্রত্যেক শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব স্থানীয় ধাঁচ ও  শৈলী রয়েছে। এগুলির মধ্যে পাঁচমুড়ার  ঘোড়াগুলিকে চারটি ধাঁচের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম  বলে মনে করা হয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া এক  ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়াও বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী উট , হাতি , গনেশ ,  নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মূর্তি তৈরী করে  টেরাকোটা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।  রাঢ় অঞ্চলে স্থানীয় লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজায় টেরাকোটা ও কাঠের ঘোড়া ব্যবহৃত হয়। অনেক গ্রামে বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গ্রামবাসীরা ঘোড়া মা...

আমার ছড়া

      ।। সধবার একাদশী ।।                                    কাবলিওয়ালার ব‌উ দেখিনি পাঞ্জাবীদের টাক দেখিনি বোরখা পরে তোলা সেলফি দেখিনি নাঙ্গা বাবার  কাপড়জামা দেখিনি। গুজরাটেতে মদ চলেনা অরুনাচলে মদের নিষেধ চলেনা নৈনীতালে ফ‍্যান চলেনা লে লাদাকে রেল চলেনা। আইসক্রীমে বরফ নেই শ‍্যাওড়া গাছে পেত্নী নেই কৃষ্ণনগরে কৃষ্ণ নেই আজ লাইফ আছে জীবন নেই।                      ।। রসগোল্লা ।।                             পান্তোয়া সন্দেশ যতকিছু আনোনা বাংলার রসগোল্লা তার নেই তুলনা। নানাভাবে তোলপাড় কতকিছু ঝামেলা নবীনের নব আবিষ্কার নাম রসগোল্লা। আসল ছানার গোল্লা সে...

অপরাজিতা

অপরাজিতা বহু বৈচিত্রে ভরা অপরাজিতা।  দেবী দূর্গার বিভিন্ন রুপের মধ‍্যে আরও একটি রুপ হল  অপরাজিতা। অপরাজিতা কথার অর্থ অপরাজেয় অর্থাৎ যাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনা।   মহর্ষি বেদব‍্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী অপরাজিতা দেবীকে আদিকাল থেকেই শ্রেষ্ঠ শক্তিদায়িনী রুপে মান‍্যতা দেওয়া হয়েছে। ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ছাড়াও অন্যান্য দেবতারা নিয়মিত আরাধনা করেন। বিজয়া দশমী বা দশেহরার সময় শক্তির রুপীনির আর এক প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়ে থাকে যাতে জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে যেন জয়ী হ‌ওয়া যায়। অপরাজিতা পুজোর পর সেই লতা হাতে ধারণ করার রীতি অনেক স্থানেই চালু আছে। মানুষের বিশ্বাস এই অপরিজিতা রুপে দেবী দূর্গা সমস্ত অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে ধর্মের পূণঃপ্রতিষ্ঠিত করে। দেবী পূরাণে ও শ্রী শ্রী চন্ডীতে এরকম কাহিনী বর্ণীত হয়েছে।             ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে এই ফুলের আবিষ্কার যার ব‍্যাপ্তি সুদূর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা পর্যন্ত। ভারতের মোটামুটি সব স্থান ছাড়াও বিদেশে যেমন ইজিপ্ট, সিরিয়া, মেসো...