আসানসোল
থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দুরে রানীগঞ্জ হয়ে বাঁকুড়া যাওয়ার পথে পড়ে বিকনা গ্রাম। বাঁকুড়া জেলার
বিষ্ণুপুরের সিল্ক, টেরাকোটা ও মন্দিরের সাথে সাথে বিকনার ডোকরা শিল্পের খ্যাতিও
আজ জগৎজোড়া। একাধিকবার বিষ্ণুপুর যাওয়া মন্দির ও টেরাকোটা শিল্প দর্শন এবং
বিষ্ণুপুর সিল্কের সঙ্গে পরিচিতি বাড়লেও ডোকরা শিল্প প্রায় অধরাই থেকে গেছিল। তাই
এবার মনস্থির করেই গেছিলাম বিষ্ণুপুর যাওয়ার পথে ডোকরা শিল্পের গ্রাম বিকনায়
কিছুটা সময় কাটিয়ে এই শিল্পের কারিগরী সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান সঞ্চয় করে যাব।
নির্দিষ্ট জায়গার কাছাকাছি এসে একজনকে জিজ্ঞেস করে সেই বাঞ্ছিত স্থানে পৌঁছে
গেলাম। একের পর এক আটচালায় ডোকরার পসরা নিয়ে শিল্পী ও তার পরিবার বসে আছে।একদম ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে
শিল্পীরা নিপুণ হাতে তাদের শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলছে। আর এই কাজে ১০ বছরের ছেলেমেয়ে
থেকে ৭০ বছরের বয়স্করাও সমানভাবে হাত লাগিয়েছে।
ডোকরা বা ঢোকরা হলো হারনো মোম ঢালাই পদ্ধতিতে এক
শিল্পকর্ম যা প্রায় ৪৫০০বছরের পুরনো বলে জানা যায়। সিন্ধু সভ্যতার সময় মহেঞ্জোদরতে
ডোকরা শিল্পের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়।মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন এই ধাতুজ
শিল্প এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। কথিত আছে ৩০০০ বছরেরও আগে বস্তারের রাজা
তাঁর স্ত্রীকে ডোকরার তৈরী গয়না উপহার দিয়েছিলেন। ভারত ছাড়াও চীন,মালয়েশিয়া,জাপান প্রভৃতি দেশে এই শিল্প কর্মের খোঁজ পাওয়া যায়। পূর্বে
এই ডোকরা শব্দটা যাযাবর গোষ্ঠীর কিছু মানুষ যারা নানারকম হাতের কাজে ব্যস্ত থাকতো
তাদের সম্বন্ধেই ব্যবহৃত হতো। এই যাযাবর গোষ্ঠীই ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন
অঞ্চল তথা বাংলা,ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশে, ঝাড়খণ্ড ও বিহার-এ ছড়িয়ে পড়ে।
মনে
করা হয় মধ্যপ্রদেশ এর বস্তার ও ছত্তিসগড়ে এই শিল্পের উদ্ভব হয়। পরে ঝাড়খণ্ড ও বিহার-এ ছড়িয়ে পড়ে। আরও পরে পশ্চিমবঙ্গ ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে এর প্রসার ঘটে। বর্তমানে
ডোকরা শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম নাম। বিভিন্ন রকম হিন্দু ও আদিম দেব দেবী,
বিভন্ন মানুষের প্রতিকৃতি, নানারকম বাসনপত্র, দৈত্য দানব ,হাতি ঘোড়া ইত্যাদি
বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার ও পশুপক্ষী এই ধাতব ঢালাই পদ্ধতির ঐতিহ্যময় বিষয়।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা যেমন বাঁকুড়া ,পুরুলিয়া, মেদিনিপুর, বীরভুম
ও বর্ধমানে ডোকরার কাজ জানা এই বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ (কর্মকার) এর বসবাস করতে
দেখা গেলেও বাঁকুড়া জেলার বিকনা গ্রাম এই ডোকরা শিল্পের জন্য এক বিশেষ স্থান অধিকার
করে রয়েছে।মূলত এই অঞ্চলই ডোকরা শিল্পের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে চলেছে বললে
অতুক্তি হয়না। ভারতবর্ষে তথা বিদেশেও এখানকার ডোকরা শিল্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বাঁকুড়ার
বিকনা গ্রামের অধিবাসীরা সবাই ডোকরা শিল্পী। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের নিপুণ
কলাকুশলীর জন্য রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যস্তরে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। National Institute for Science, Technology and Development Studies NISTADS ডোকরা শিল্পের প্রসার ও শিল্পিদের
নিয়ে নানারকম গবেষণা মূলক কাজকর্ম করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এই শিল্পের উন্নতিকল্পে নানারকম পদক্ষেপ গ্রহন
করছে।

এখানকারই
দুই প্রবীন শিল্পী বলরাম কর্মকার ও সুবল কর্মকার দের সঙ্গে কথা বলে ডোকরা তৈরীর
প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনেকটাই জানা গেল। প্রায় পাঁচ ছয়টি ধাপে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের
হাতে তৈরী হয় ডোকরার বিভিন্ন সামগ্রী। এরজন্য মূল উপাদানগুলি হল মিহি করে গুঁড়ো করা মাটি, ধুনো ও
তেল মেশানো আঁটা বা মন্ড, মৌচাক থেকে ভেঙ্গে আনা মোম, পেতল, কাঠকয়লা ইত্যাদি।
Ø প্রথম ধাপে মাটিকে গুঁড়ো করে চালুনি দিয়ে খুব মিহি করে চেলে
নেওয়া হয়। এরপর ধানের তুষ ও পরিমান মতো বালি মিশিয়ে মন্ড করা হয়। যে মুর্ত্তি বা বস্তু তৈরী করা হবে ঐ
মাটির মন্ড দিয়ে তেমন আকৃতির আদলে একটা প্রাথমিক রুপ দেওয়া হয়। তার ওপরে গুঁড়ো
মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয় যাতে আগুনে গরম করার সময় ফেটে না যায়। পরে
সেগুলিকে ভাল করে শুকনো করা হয়।
Ø দ্বিতীয় ধাপে মৌচাকে মোমগুলিকে একটি পাত্রে গরম করে গলিয়ে
তার সঙ্গে কিছুটা ধুপের গুঁড়ো ও তেল দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে চিটচিটে আঁঠার মত হলে
শুকনো মুর্ত্তির ওপর ভরাট করে প্রলেপ দেওয়া হয়।
Ø এরপর ঐ গলানো মোমের কিছুটা অংশ একটু ঠান্ডা করে সরু সরু
লেচি কাটার মতো কেটে বিভিন্ন মুর্ত্তির হাত পা তৈরী হয়। আরও সরু সুতোর মত লম্বা
আকৃতির টুকরো করে নানারকম সাজসজ্জা ও কারুকার্য তৈরীর কাজে লাগে।
Ø এইভাবে মুর্ত্তিগুলির অঙ্গ প্রতঙ্গ ও সাজসজ্জা তৈরীর পর
পাতলা মাটি ,ধানের তুষ ও বালি একসঙ্গে মেখে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে দেওয়া হয়।
Ø মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢাকার পর বড় ছুঁচ বা ছুরি দিয়ে
মুর্ত্তিগুলির গায়ে চ্যানেল তৈরী করা হয় যার মধ্য দিয়ে গলানো পেতল প্রবেশ করানো
হয়ে থাকে।
Ø মুর্ত্তিগুলিকে আগুনে পোড়ানর সময় মোমের প্রলেপ গলে বেড়িয়ে
গিয়ে শুন্যতার সৃষ্টি হয় এবং গলানো পেতল সেই স্থান গুলো ভরাট করে। সম্পূর্ণরুপে
ভরাট হয়ে গেলে একটি পাত্রে জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে ঠান্ডা করে যত্ন সহকারে একটু
একটু করে মাটির প্রলেপ গুলো ছাড়ানো হয়।
Ø এরপর চলে ফিনিশিংএর কাজ যা এইসব শিল্পীরা নিজেদের দক্ষতা ও
পারদর্শীতায় ফুটিয়ে তোলে।
এতগুলো ধাপ পেরিয়ে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের হাতে অপূর্ব শিল্প
কলার সাহায্যে তৈরী হয়ে থাকে এই ডোকরা। এত পরিশ্রম করে বানানো মুর্ত্তিগুলির
দেশবিদেশে যতই আকর্ষণ থাকনা কেন এর বাজার কিন্তু খুব একটা লাভজনক নয়। এইসব
শিল্পীদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দেখলেই তা বোঝা যায়। এর প্রধান কারন কাঁচামালের
ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। এতরকম কাঁচামাল ও পরিশ্রম দিয়ে তৈরী হওয়া মুর্ত্তিগুলির যা
দাম ধার্য্য করা হয় ঠিক ততদামে তা বিক্রি করা কষ্টসাপেক্ষ হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে কম
দামেও তা ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলস্বরুপ এদের পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তাদের
পূর্বপুরুষের শিল্পকলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
আমরা
গিয়ে একটু একটু করে তাদের ঘরের মধ্যে গিয়ে অনেক সুখ দুঃখের গল্পের অংশীদার হলাম। পুতুল
কর্মকার নামে এক মহিলা শিল্পী খুবই আনন্দ সহকারে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন।
সম্প্রতি তার ইনটারভিউ টিভিতে প্রচারিত হয়েছে । এ ছাড়াও সে টিভি শোতে অংশগ্রহনের
অভিজ্ঞতাও আমাদের শোনাল। এইরকম ভাবে উৎসাহ পেলে তারা মানসিক ভাবে বলিষ্ঠ হয়। তারই
ফাঁকে এক এক করে ডোকরার পসরা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির করলো। ছোটবড় নানারকম জিনিষ
যেমন একচালার মধ্যে দূর্গা প্রতিমা, বিভিন্ন আকৃতির গনেশ, আদিবাসী মুর্ত্তি ,
প্যাঁচা, ঘোড়া ও তার সাথে আধুনিক ফ্যাশন অনুযায়ী দুল, বালা, গলার মালা ও বিভিন্ন
গয়না প্রত্যেকটি জিনিষই আকর্ষণীয় তথা লোভনীয়। অনেক কিছুই নেওয়ার আগ্রহ হলেও দামের
জন্য নিজেদের সংযত করে কিছু কেনাকাটা করতেই হল।
আর
বেশিক্ষণ সময় দেওয়া সম্ভব হলনা এগিয়ে যেতে হবে আর শিল্পকর্মের পীঠস্থান বিষ্ণুপুর।
কৃতজ্ঞতা
স্বীকারঃ Wikipedia
The
Dhokra Artisans of Bankura and Dariapur, West Bengal: A Case Study and
Knowledge Archive of Technological Change in Progress David
Smith, Newport, UK Rajesh Kochhar, New Delhi, India
Chitrolekha
International Magazine on Art and Design,
Comments
Post a Comment