Skip to main content

এঁচোড়

এঁচোড়

গতকাল বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় মন্টুর গুমটি থেকে একটা কিলোখানেক এঁচোড় কিনে এনেছিলাম। পাড়ার মোড়ে তরিতরকারি বিক্রি করে মন্টু, সঙ্গে ডিম পাঁউরুটিও রাখে।সময় অসময় কাজ চলে যায়। পাশ দিয়ে পেরোতেই ছেলেটা ডেকে বললো,
   'ও ঘোষদা এঁচোড়টা নিয়ে যান একদম ফ্রেশ'।
   'নারে ভাই এই অবেলায় এঁচোড় নিয়ে গেলে তোর বৌদি রাগারাগি করবে'।
বৌদির ওপর অগাধ আস্থা দেখিয়ে বলে
    'কি যে বলেন, বৌদি কিছু বলবেন না, বলে দেবেন মন্টু জোর করে দিয়েছে। তাছাড়া একদম
টাটকা, কাল কাটবেন তাই ছাড়ালাম না'।
এতটা ভরসা দেওয়ার পর আর না বলতে পারলাম না, একটা ক‍্যারি ব‍্যাগে বাড়িতে নিয়েই গেলাম আর তাতেই যতো বিপত্তি।
    প্লাস্টিক ব‍্যাগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে এক কাপ চা দিতে বললাম। মানসীর কান পর্য্যন্ত‍ না পৌছলেও চোখটা কিন্তু টেবিলের উপরে ঠিকই গেছে।
    'এই ভর সন্ধ্যায় এটা আবার কি আনলে'
    'না মানে ঐ এঁচোড় , মন্টুর দোকান থেকে, একদম ফ্রেশ জোর করে দিলো, কাল কাটলেও চলবে, কটা চিংড়ি মাছ এনে দেবো দারুন হবে'।
    'এ্যঁ…জোর করে দিলে, কাল কাটলেও চলবে, চিংড়ি মাছ এনে দেবো, নোলা দেখো। বলি দশটা দাসী বাঁদি আছে যে কাল এসে তারা তোমার সাধের এঁচোড় কেটে পঞ্চব‍্যাঞ্জন করে পাতে সাজিয়ে দেবে'।
     'এনেছি তো একটা এঁচোড় তাই নিয়ে এতো কথা, আর কতো যে পঞ্চব‍্যাঞ্জন করো সে তো দেখতেই পাই। খাবার টেবিলে শুধুতো থোড় বড়ি খাড়া'।
    'অত‌ই যদি নোলা দাসী বাঁদিদের বললেই পারো, রাতদিন হাড়মাস এক করে তোমার পেছনে খিদমত করার জন্যে বাপের বাড়ী থেকে এসেছি বুঝি'!  
    'নিজে না পারো একটা কাউকে আনলেই পারতে। বাপের বাড়ী থেকে কিযে ছাই এনেছো'!
    'বাপের বাড়ি তুলে কথা কথা বলবেনা বলে দিচ্ছি, এতদিনে তুমি কি দিয়েছো শুনি পূজায় দুটো শাড়ী আর এ গন্ডা ছেলেপুলে'।
    'আর এই টিভি ফ্রিজ , ফি বছর বেড়াতে যাওয়া এসব হাওয়া থেকে আসে, বাপের বাড়ি দেখাচ্ছে, ঐতো দুকামরার একটা দেশলাই বাক্স তার‌ই এতো অহংকার'।
    'ঐ যা আছে তোমার চোদ্দপুরুষের ক্ষমতায় কুলবেনা'।
     'খবরদার বংশ তুলে কথা বলবেনা, ভালো হবেনা'।
     ' কি করবে মারবে? ডোমেস্টিক  ভায়োলেন্সের কেস করব'।
     'কি বললে, আর একবার বলো...'।
নিচে থেকে বড় মেয়ে শান্তির ধমকানি 'ঘরে কাক চিল বসতে দেবেনা নাকি, এবার তোমরা থামবে'!
বলতে বলতে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে 'এই নাও বাবা' বলে এগিয়ে দিলো। এতো মিষ্টি মধুর সংলাপের চাপে চা এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
    'ভাগ‍্যে তুই ছিলি ন‌ইলে এটুকুও জুটতোনা'।
    'ওরে আমার বাপ সোহাগী বেটি রে, চোখ বুজলে দেখবে কে কত সেবা করে'।
    'সেটা তুমি ই বুঝবে, আমি চলে গেলে কোথা থেকে ঐ চিতল মাছের পেটি, মুরগির ঠ‍্যাং, ভ‍্যানিটি ব‍্যাগ ঝুলিয়ে বেড়াতে যাওয়া কোথা থেকে আসবে, কে জোগাবে'! আর‌ও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে গলা চড়িয়ে বলে , কিচ্ছু এসে যাবে না। কি আমার মহাপুরুষ রে, কার‌ও জন্যে কিছু আটকায় না।
আর থেমে না থেকে শান্তির ঘাড়ে হাত দিয়ে টানতে টানতে বেড়িয়ে গেল 'এখানে থাকলে চলবে, পিন্ডির জোগাড় করতে হবেনা'!
      চা খাওয়ার আর কোনো আগ্ৰহ নেই। সাত পাঁচ ভাবনা মাথায় আসতে শুরু হয়েছে। কিসের সংসার, কার সংসার। ঠাকুরের কথাই ঠিক মোহ মায়া সব ত‍্যাগ না করতে পারলে মুক্তি পাওয়ার পথ বড়ই কঠিন। একটা নির্ণয় নিতেই হবে। দিন কয়েক আগেই ডাক্তার হাইপ্রেসারের ওষুধের  সাথে ঘুমের ওষুধও দিয়েছিলো। এখনো অনেক গুলোই আছে। নির্ণয় নিয়ে ফেলেছি , কিছু একটা
করতেই হবে। মন আরও শক্ত করতে হবে।
      'বাবা খাবে এসো' শান্তির ডাকে সম্বিত ফিরে এলো, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে   ছেলেমেয়েদের সাথে খেতে বসলাম, বসে কোন কথাবার্তা হলো না। তাড়াতাড়ি খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে শোবার ঘরে ওষুধ খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে  পড়েছি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে করতে পারছিনা, একদম মড়ার ঘুম।
       সকাল থেকে মানসীর যথারীতি চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। কখন তেজ দেখিয়ে উঠে চলে গেছে, একবার ঘুরে দেখেওনি। শান্তিকে জিজ্ঞেস করে বাবা উঠলো কিনা!
     'কিগো কতো বেলা হ'লো খেয়াল আছে, বাজার যেতে হবেনা?  দুধ পাওয়া যাবেনা। বেশী বেলা হলে ভালো মাছ পাওয়া যাবেনা'।
     'ডাকো ডাকো যতো খুশি ডাকো, দুধ খাবে, দেরী হলে ভালো মাছ পাওয়া যাবেনা'।
    ছেলমেয়ে গুলোকে তাগাদা দিয়েও কোনো লাভ হ'লনা, তারা ভাবছে আহা রাগারাগি করে বাবা শুয়েছে, একটু আরাম করে উঠুক। কোথায় কি, মানসী এবার সব রাগ অভিমান ফেলে ঘরে ঢুকে কাছে এসে ডাকতে থাকে, ' কিগো আর কতক্ষণ রাগ করে থাকবে এবার ওঠে পড়ো, বেলা অনেক হলো বাজার করতে হবেনা। একটু চিংড়ি নিয়ে এসো এঁচোড় দিয়ে করে  দেবো'।
    ' অনেক দেরি করে ফেলেছ মানসী, আর কোনো লাভ নেই'।       
    গায়ে হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে পাশ ফেরাতেই
নিথর শরীরটা এলিয়ে পড়লো। আঁতকে বলে উঠে 'কি হলোগো, ও শান্তি ও পাপু তাড়াতাড়ি আয় দেখ তোদের বাবার কি হলো, কোনো সাড়া দিচ্ছেনা, গা হাতপা একদম ঠাণ্ডা'।
চিৎকার শুনে অনেকেই ভীড় জমাতে শুরু করেছে। কৌতূহল নিয়ে নানাজনে নানা প্রশ্ন করছে। 'যতই কৌতূহল দেখাও আমি কিছুই বলবো না, দেখ্ কেমন লাগে'। পায়ের তলা হাতের তালু ঘসে গরম করার চেষ্টা করছে। কিস্সু হবেনা, পাখি অনেকক্ষণ উড়ে গেছে মানসী। হাজার চেষ্টা করো কোনো লাভ নেই।      
   " বাসাংসি জীর্ণানি য়থা বিহায়
     নবানি গৃহ্নাতি নরহোপরাণি।....."
(পুরাতন বস্ত্র ত‍্যাগ করার মতো আমার আত্মা এই দেহ ত‍্যাগ করেছে....)।
     ডা‍ঃ অভিজিৎ ব‍্যনার্জীকে ডাকা হয়েছে, আমার‌ই বন্ধু একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। সেই আমার‌ রেফারেন্স‌ই দরকার হলো। বাইরের লোক সবাইকে বার করে দিয়ে একান্তে পরীক্ষা করে মানসীকে শান্তনা দিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলো।
    'এ যাত্রায় বড় বাঁচিয়ে দিলি অভিজিৎ , মড়ার পর কাঁটা ছেঁড়া করতে হলনা, একি কম পাওনা'!
ডাক্তার কনফার্ম করার পর শোকটা ফেটে পড়লো। মানসী ও ছেলেমেয়ে গুলো ঢুকরে কেঁদে উঠলো। বুকের ওপর আছড়ে পড়ে মানসী কাঁদতে লাগলো ' ওগো তুমি আমার একি সর্বনাশ করলেগো....'। যতই বুকের ওপরে কান্নাকাটি করো আমি কিছ্ছুটি বলবোনা, আসল ব‍্যাপারটা জানতেও পারলেনা।দেখ চুপ থাকার মজাটা। আত্মীয় স্বজন সবাই এসে পড়েছে। তারা যে যার পছন্দমতো গল্প তৈরী করছে। সব কথাই কানে আসছে। তবে আমার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর চন্দনের ফোঁটা দিয়ে আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে হচ্ছিল রজনীগন্ধার মালা পড়ার , সুযোগই পাচ্ছিলাম না।
      এধার ওধার থেকে অনেক লোক জড়ো হয়েছে, অফিস থেকেও বেশ কয়েকজন এসেছে শোক জানাতে। তবে অধিক সন্ন‍্যা সীতে গাজন নষ্ট হতে চলেছে। এতো দেরী হচ্ছে কেন। বডিটা এবার ভারী হয়ে যাচ্ছে। বডিতে পচন শুরু হয়ে যাবে তা থেকে গন্ধ বেরোবে। যে মানসী এতক্ষণ বুকে আছড়ে কাঁদছিল তাকেই এবার নাকে কাপড় চেপে পাশে বসতে হবে। শ্মশানের খরচ বলে তো একটা জিনিস আছে, কিন্তু আমি বলি কি করে যে আলমারিতে আলাদা করে কিছু টাকা রাখা আছে। না মানসীর এটা জানা নেই।
      অফিসের কালিগরাই সব ব‍্যাবস্থাই করেছে।কিছূক্ষণের মধ্যেই সৎকার সমিতির কাঁচের ঘেরা দেওয়া গাড়ি চলে এসেছে। আজকাল আর বাঁশের চাঙ্গের খুব একটা দরকার পড়েনা। স্ট্রেচার চলে এলো খাটের পাশে‌। ধরাধরি করে আমায় নামিয়ে শোয়ানো হলো। আর একপ্রস্থ কান্নার পর্ব শুরু হলো। তার‌ই মাঝে মানসী তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে প্লাস্টিক‌ ব‍্যাগে ভরা সেই এঁচোড়টা নিয়ে এসে মাথার কাছে রেখে দিয়ে ওটাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বললো। কৌতূহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে জানার চেষ্টা করলেও কেউ কিছু বুঝতে পারলনা। একটু দুরে আড়াল মন্টু দাঁড়িয়ে, সে খানিকটা আঁচ করতে পারলো কিনা কে জানে!
        ড‍্যাং ড‍্যাং করে কটা লোকের ঘাড়ে চেপে চললাম, কিছুদিন আগে না হয় পরে। পাশ থেকে কয়েকজন বলে উঠলো বলহরি, হরিবোল...।

Comments

Popular posts from this blog

বাঁকুড়ার টেরাকোটা

                                                                বাঁকুড়ার টেরাকোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা  ভারতের শিল্পকর্মের এক বিশেষ স্থান   অধিকার করে আছে।  বাঁকুড়ার  পোড়ামাটির  ঘোড়া ও হাতি নির্মাণের  প্রধান শিল্প  কেন্দ্র গুলি   হল পাঁচমুড়া,  রাজাগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর।  প্রত্যেক শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব স্থানীয় ধাঁচ ও  শৈলী রয়েছে। এগুলির মধ্যে পাঁচমুড়ার  ঘোড়াগুলিকে চারটি ধাঁচের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম  বলে মনে করা হয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া এক  ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়াও বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী উট , হাতি , গনেশ ,  নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মূর্তি তৈরী করে  টেরাকোটা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।  রাঢ় অঞ্চলে স্থানীয় লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজায় টেরাকোটা ও কাঠের ঘোড়া ব্যবহৃত হয়। অনেক গ্রামে বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গ্রামবাসীরা ঘোড়া মা...

আমার ছড়া

      ।। সধবার একাদশী ।।                                    কাবলিওয়ালার ব‌উ দেখিনি পাঞ্জাবীদের টাক দেখিনি বোরখা পরে তোলা সেলফি দেখিনি নাঙ্গা বাবার  কাপড়জামা দেখিনি। গুজরাটেতে মদ চলেনা অরুনাচলে মদের নিষেধ চলেনা নৈনীতালে ফ‍্যান চলেনা লে লাদাকে রেল চলেনা। আইসক্রীমে বরফ নেই শ‍্যাওড়া গাছে পেত্নী নেই কৃষ্ণনগরে কৃষ্ণ নেই আজ লাইফ আছে জীবন নেই।                      ।। রসগোল্লা ।।                             পান্তোয়া সন্দেশ যতকিছু আনোনা বাংলার রসগোল্লা তার নেই তুলনা। নানাভাবে তোলপাড় কতকিছু ঝামেলা নবীনের নব আবিষ্কার নাম রসগোল্লা। আসল ছানার গোল্লা সে...

অপরাজিতা

অপরাজিতা বহু বৈচিত্রে ভরা অপরাজিতা।  দেবী দূর্গার বিভিন্ন রুপের মধ‍্যে আরও একটি রুপ হল  অপরাজিতা। অপরাজিতা কথার অর্থ অপরাজেয় অর্থাৎ যাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনা।   মহর্ষি বেদব‍্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী অপরাজিতা দেবীকে আদিকাল থেকেই শ্রেষ্ঠ শক্তিদায়িনী রুপে মান‍্যতা দেওয়া হয়েছে। ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ছাড়াও অন্যান্য দেবতারা নিয়মিত আরাধনা করেন। বিজয়া দশমী বা দশেহরার সময় শক্তির রুপীনির আর এক প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়ে থাকে যাতে জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে যেন জয়ী হ‌ওয়া যায়। অপরাজিতা পুজোর পর সেই লতা হাতে ধারণ করার রীতি অনেক স্থানেই চালু আছে। মানুষের বিশ্বাস এই অপরিজিতা রুপে দেবী দূর্গা সমস্ত অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে ধর্মের পূণঃপ্রতিষ্ঠিত করে। দেবী পূরাণে ও শ্রী শ্রী চন্ডীতে এরকম কাহিনী বর্ণীত হয়েছে।             ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে এই ফুলের আবিষ্কার যার ব‍্যাপ্তি সুদূর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা পর্যন্ত। ভারতের মোটামুটি সব স্থান ছাড়াও বিদেশে যেমন ইজিপ্ট, সিরিয়া, মেসো...