Skip to main content

মন্দিরের মাঝে মুলুটি


 দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…..” কবির এই উক্তিটি আংশিক হলেও এখানে প্রজোয্য। বীরভূমের রামপুরহাটকে কেন্দ্র করে কতো যে দেব ভূমি বর্তমান আগে জানা থাকলেও আমার গ্রামের বাড়ি রামপুরহাটের মাত্র ১৫ কিমি দুরে হলেও অনেক কিছু অদেখা থেকে গেছে।
এবার বাড়ি গিয়ে ঠিক হলো রামপুরহাট হয়ে ১৬ কিমি দুরে মুলুটি যাওয়া হবে। বীরভূম ঝাড়খন্ডের লাগোয়া দুমকা জেলার সুড়িচোয়া মোড়ে ৪ কিমি দুরে ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত পুরাতাত্বিক ও ধর্মীয় মহত্বে ভরা মুলুটি গ্রাম।




 

পঞ্চদশ শতকের নানকর রাজের (কর মুক্ত সাম্রাজ্য) রাজধানী হিসেবে শিরোনামে আসে মালুটি গ্রাম। গৌড় সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এই গ্রামটি উপহার দেন গরীব ব্রাহ্মন সন্তান বসন্ত রায়কে। ওড়িশা থেকে লোক লস্করসহ ফেরার সময় বিশ্রামের কারনে এই অঞ্চলে থামেন এরপর বেগমের অতি প্রিয় এক বাজ পাখি উড়ে যায়। ঐ অঞ্চলের এক অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ বসন্ত রায় সুলতালের পোষা বাজপাখিটি ধরে ফেরত দেওয়ার জন্যে পুরষ্কার স্বরূপ এই উপহার প্রদান করেন সম্রাট। তার নাম দেওয়া হয় রাজা বাজ বসন্ত। কাশী সুমেরু মঠের দন্ডি সন্যাসী বাজ বসন্তকে রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। অপর একটি মতে বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজাদের অঞ্চল মল্লহাটি হিসেবে মালুটি নাম হয়েছে। বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, উত্তরে পাকুড় এবং ছোট নাগপুর মালভূমির কিছু অংশ নিয়ে মল্লভূম হিসেবে পরিচিত ছিল মল্ল রাজ সাম্রাজ্য।

        এই গ্রামে একই জায়গায় এতগুলি মন্দির তৈরি হওয়ার ইতিহাসটি গল্পাকারে প্রচলিত। বাজ বসন্ত রাজারা প্রাসাদ তৈরীর বদলে মন্দির নির্মান করতেন। রাজপরিবার সময়ের সাথে সাথে নানা তরফে ভেঙে যায়, প্রতিটি তরফ মন্দির তৈরী করতে থাকেন একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে। এভাবেই মালুটি গ্রাম মন্দিরে ভরে যায়। আরো অতীতে শুঙ্গ বংশের (১৮৫ খৃ:পূর্ব - ৭৫ খৃ: পূর্ব) সময় মালুটি সুখ্যাত ছিল গুপ্ত কাশী নামে। কালের অমোঘ নিয়মে ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ মন্দিরই আজ ধ্বংশের মুখে ।মালুটি গ্রামে বর্তমানে ৭২ টি মন্দির আছে। 



 অতীতে নানকর রাজারা এখানে ১০৮ টি মন্দির নির্মান করে ছিল বলা হয়, কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এগুলির রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা করে, ফলত ৩৬ টি মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মন্দিরগুলিতে নির্দিষ্ট শিল্পরীতির বদলে দ্রাবিড়, নাগারা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির মিশ্র শিল্পকর্মের ছাপ পাওয়া যায়। মূলত এগুলি শিব, দূর্গা, বিষ্ণু ও কালী মন্দির। মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির (টেরাকোটা) কাজে হিন্দু পুরাণ রামায়ন, মহাভারতের কাহিনী চিত্রায়িত আছে। এখানকার বাৎসরিক কালীপুজা অত্যন্ত বিখ্যাত। একশোর অধিক ছাগ বলি দেওয়ার রীতি বহুকাল থেকে প্রচলিত মালুটিতে। ভগ্নপ্রাপ্ত মন্দিরগুলি  মেরামতির কাজ চলছে তবে অধিকাংশ মন্দিরের গায়ের কাজ ফিরিয়ে আনার বিশেষ চেষ্টা নজরে পড়েনি।






বজ্রায়নী বৌদ্ধ, তান্ত্রিক সাধকরা এখানে আসতেন। তারই সূত্রে মালুটি গ্রামের মৌলিক্ষ্যা মাতার মন্দিরটি সবচেয়ে পুরোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন। দন্ডিস্বামী ও রাজার বংশধরেরা জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যাক্ত এক প্রাচীন মন্দিরের ভেতর প্রস্তর নির্মিত এক অপূর্ব দেবীর মস্তক উদ্ধার করেন। লালরঙের আভাযুক্ত ত্রিনয়নী, মৃদুহাস্যময়ী এই দেবীমস্তক দেবী মৌলীক্ষা নামে খ্যাত হয়। ইনিই সেই আদ্যাশক্তি দূর্গা।

 

পাটলিপুত্র রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন মালুটিতে।এও বলা হয় আদি শঙ্করাচার্য কাশী  বা বারাণসী শঙ্করাচার্য কাশী বা বারাণসী যাওয়ার পথে এখানে থেমেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী হিন্দু জাগরণ আন্দোলনের সূচনা তিনি এখান থেকেই শুরু করেন। 
১৮৫৭ সালে বাঙালি তান্ত্রিক সাধক বামদে বা বামাখ্যাপা মালুটিতে আসেন। তিনি প্রায় আঠেরো মাস এই গ্রামের মৌলিক্ষ্যা মন্দিরে অবস্থান করেন। তিনি তারাপীঠে যাওয়ার আগে প্রথম সিদ্ধিলাভ করেন এখানেই।এখানেই সাধক বামাক্ষ্যাপা তাঁর অলৌকিক শক্তির অনেক নিদর্শন রেখে যান যেগুলি লোকমুখে আজও শোনা যায়।


Comments

  1. অনেক কিছু জানলাম।ছবিগুলো দেখে খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বাঁকুড়ার টেরাকোটা

                                                                বাঁকুড়ার টেরাকোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা  ভারতের শিল্পকর্মের এক বিশেষ স্থান   অধিকার করে আছে।  বাঁকুড়ার  পোড়ামাটির  ঘোড়া ও হাতি নির্মাণের  প্রধান শিল্প  কেন্দ্র গুলি   হল পাঁচমুড়া,  রাজাগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর।  প্রত্যেক শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব স্থানীয় ধাঁচ ও  শৈলী রয়েছে। এগুলির মধ্যে পাঁচমুড়ার  ঘোড়াগুলিকে চারটি ধাঁচের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম  বলে মনে করা হয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া এক  ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়াও বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী উট , হাতি , গনেশ ,  নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মূর্তি তৈরী করে  টেরাকোটা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।  রাঢ় অঞ্চলে স্থানীয় লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজায় টেরাকোটা ও কাঠের ঘোড়া ব্যবহৃত হয়। অনেক গ্রামে বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গ্রামবাসীরা ঘোড়া মা...

আমার ছড়া

      ।। সধবার একাদশী ।।                                    কাবলিওয়ালার ব‌উ দেখিনি পাঞ্জাবীদের টাক দেখিনি বোরখা পরে তোলা সেলফি দেখিনি নাঙ্গা বাবার  কাপড়জামা দেখিনি। গুজরাটেতে মদ চলেনা অরুনাচলে মদের নিষেধ চলেনা নৈনীতালে ফ‍্যান চলেনা লে লাদাকে রেল চলেনা। আইসক্রীমে বরফ নেই শ‍্যাওড়া গাছে পেত্নী নেই কৃষ্ণনগরে কৃষ্ণ নেই আজ লাইফ আছে জীবন নেই।                      ।। রসগোল্লা ।।                             পান্তোয়া সন্দেশ যতকিছু আনোনা বাংলার রসগোল্লা তার নেই তুলনা। নানাভাবে তোলপাড় কতকিছু ঝামেলা নবীনের নব আবিষ্কার নাম রসগোল্লা। আসল ছানার গোল্লা সে...

অপরাজিতা

অপরাজিতা বহু বৈচিত্রে ভরা অপরাজিতা।  দেবী দূর্গার বিভিন্ন রুপের মধ‍্যে আরও একটি রুপ হল  অপরাজিতা। অপরাজিতা কথার অর্থ অপরাজেয় অর্থাৎ যাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনা।   মহর্ষি বেদব‍্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী অপরাজিতা দেবীকে আদিকাল থেকেই শ্রেষ্ঠ শক্তিদায়িনী রুপে মান‍্যতা দেওয়া হয়েছে। ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ছাড়াও অন্যান্য দেবতারা নিয়মিত আরাধনা করেন। বিজয়া দশমী বা দশেহরার সময় শক্তির রুপীনির আর এক প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়ে থাকে যাতে জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে যেন জয়ী হ‌ওয়া যায়। অপরাজিতা পুজোর পর সেই লতা হাতে ধারণ করার রীতি অনেক স্থানেই চালু আছে। মানুষের বিশ্বাস এই অপরিজিতা রুপে দেবী দূর্গা সমস্ত অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে ধর্মের পূণঃপ্রতিষ্ঠিত করে। দেবী পূরাণে ও শ্রী শ্রী চন্ডীতে এরকম কাহিনী বর্ণীত হয়েছে।             ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে এই ফুলের আবিষ্কার যার ব‍্যাপ্তি সুদূর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা পর্যন্ত। ভারতের মোটামুটি সব স্থান ছাড়াও বিদেশে যেমন ইজিপ্ট, সিরিয়া, মেসো...