### মহালয়া কি এবং কেন ###
হিন্দু মহাকাব্য অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করতে হয়। যাঁরা বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে অপারগ, তাঁদের এই সময় পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা বিধেয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। এই পিতৃপক্ষের শেষ দিনই অর্থাৎ অমাবস্যা তিথি মহালয়া হিসেবে পরিচিত। মহালয়ার অর্থ হলো মহান (বিশাল) আলয় (আলয়)। এইদিন পূর্বপুরুষের আত্মা পিণ্ড ও জল গ্রহন করার জন্যই মর্তে সন্তানদের অতি নিকটবর্তি স্থানে বিচরন করেন ও তারপর যথাবিহিত শ্রাদ্ধের পর স্বর্গে গমন করেন। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ।


মহাভারত অনুযায়ী, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ যমকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি।


করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু
তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি বা সেরকম কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এই কারণে কর্ণকে এই বিশেষ সময়ে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। ধর্মরাজের আদেশমতো মর্তে এসে তার পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল দান করে পুনরায় গমন করেন।
মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী অন্য চিত্তাকর্ষক কাহীনি বর্নিত আছে। মহাদেবের আশির্বাদ পাওয়ার পর অসুররা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে দেবতাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যেতে থাকে । কারন জানা ছিল কোনো নারী শক্তি ছাড়া অসুরের নিধন সম্ভব নয়। সমস্ত দেবতার অনুরোধে মহাদেব হিমালয় কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করে। পার্বতীই মহাদেবের আসল শক্তি। বিবাহের পর পার্বতী তপস্যায় নিমগ্ন হন। দীর্ঘদিন তপস্যার পূর্ণ শক্তি নিয়ে প্রকাশিত হন। তখন শিব ও পার্বতী দুজনেই অর্ধনারীশ্বর মুর্তি ধারন করেন ও বোঝান নারী পুরুষ দুজনেই সমান,পুরুষ হলো দৈহিকশক্তি (physical strength) আর নারী অন্তেরর শক্তি (inner strength). পার্বতীর বিভিন্ন রুপের মধ্যে এক রুপ হলো দূর্গা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মিলিত শক্তি থেকে উদ্ভুত্হয় দশভূজা দেবী দূর্গা। মহিষাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে দশ হাতে বিভিন্ন দেবতার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এই মহালয়ার দিন অবতীর্ণ হন দূর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গা। এরপরই শুরু হয় দেবী পক্ষ। ভারতবর্ষে বিশেষত বাংলায় প্রতি ঘরে মহা সাড়ম্বরে পালিত হয় দেবী দূর্গার আরাধনা।
এই প্রসঙ্গে আজ আর একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে সবটাই অপূর্ন থেকে যাবে, তা হলো মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় আকাশবাণী কর্তৃক প্রচারিত গীতি আলেক্ষ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমারের রচনা, বীরেন্দ্রনাথের কন্ঠে শ্রীশ্রী চন্ডীর অংশবিশেষ পাঠ ও বিভিন্ন প্রথিতযশা শিল্পীদের কন্ঠে গান সৃষ্ট এই গীতি আলেক্ষ ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়ে আছে। ১৯৩০ সাল থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠান আজও অমলিন আজও বাংলার প্রতিটি মানুষ মহালয়ার পূন্য প্রভাতে এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এখনও বহু মানুষের কাছে মহালয়া মানে বিশেষ গীতি আলেক্ষ এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
শেষ করার আগে সর্বশক্তিময়ী দূর্গতিনাশিনী অসুরদলনী দেবী দূর্গার কাছে জোড় হাতে নতমস্তকে প্রার্থনা করে বলি
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিবূপেণ সংস্থিতা নমস্তই নমস্তই নমো নমঃ”।“.........................
রূপম দেহী, জয়ম দেহী, যশো দেহী, দ্বীশো জহী” ।
Comments
Post a Comment