Skip to main content

মহালয়া কি এবং কেন


### মহালয়া কি এবং কেন ###

আত্মা অবিনশ্বর অর্থাৎ আত্মার মৃত্যু নেই, এই তত্বের ওপর ভিত্তি করেই হিন্দুধর্ম এতযুগ ধরে তার গতি বজায় রেখেছে। পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

হিন্দু মহাকাব্য অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করতে হয়। যাঁরা বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে অপারগ, তাঁদের এই সময় পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা বিধেয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। এই পিতৃপক্ষের শেষ দিনই অর্থাৎ অমাবস্যা তিথি মহালয়া হিসেবে পরিচিত। মহালয়ার অর্থ হলো মহান (বিশাল) আলয় (আলয়)। এইদিন পূর্বপুরুষের আত্মা পিণ্ড ও জল গ্রহন করার জন্যই মর্তে সন্তানদের অতি নিকটবর্তি স্থানে বিচরন করেন ও তারপর যথাবিহিত শ্রাদ্ধের পর স্বর্গে গমন করেন। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ।


মহাভারত অনুযায়ী, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ যমকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। 

তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান 
করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু 
তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি বা সেরকম কোনো সুযোগ  হয়ে ওঠেনি। এই কারণে কর্ণকে এই বিশেষ সময়ে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। ধর্মরাজের আদেশমতো মর্তে এসে তার পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল দান করে পুনরায় গমন করেন।
মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী অন্য চিত্তাকর্ষক কাহীনি বর্নিত আছে। মহাদেবের আশির্বাদ পাওয়ার পর অসুররা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে দেবতাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যেতে থাকে । কারন জানা ছিল কোনো নারী শক্তি ছাড়া অসুরের নিধন সম্ভব নয়। সমস্ত দেবতার অনুরোধে মহাদেব হিমালয় কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করে। পার্বতীই মহাদেবের আসল শক্তি। বিবাহের পর পার্বতী তপস্যায় নিমগ্ন হন। দীর্ঘদিন তপস্যার পূর্ণ শক্তি নিয়ে প্রকাশিত হন। তখন শিব ও পার্বতী দুজনেই অর্ধনারীশ্বর মুর্তি ধারন করেন ও বোঝান নারী পুরুষ দুজনেই সমান,পুরুষ হলো দৈহিকশক্তি (physical strength) আর নারী অন্তেরর শক্তি (inner strength). পার্বতীর বিভিন্ন রুপের মধ্যে এক রুপ হলো দূর্গা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মিলিত শক্তি থেকে উদ্ভুত্হয় দশভূজা দেবী দূর্গা। মহিষাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে দশ হাতে বিভিন্ন দেবতার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এই মহালয়ার দিন অবতীর্ণ হন দূর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গা। এরপরই শুরু হয় দেবী পক্ষ। ভারতবর্ষে বিশেষত বাংলায় প্রতি ঘরে মহা সাড়ম্বরে পালিত হয় দেবী দূর্গার আরাধনা।



                এই প্রসঙ্গে আজ আর একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে সবটাই অপূর্ন থেকে যাবে, তা হলো মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় আকাশবাণী কর্তৃক প্রচারিত গীতি আলেক্ষ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমারের রচনা, বীরেন্দ্রনাথের কন্ঠে শ্রীশ্রী চন্ডীর অংশবিশেষ পাঠ ও বিভিন্ন প্রথিতযশা শিল্পীদের কন্ঠে গান সৃষ্ট এই গীতি আলেক্ষ ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়ে আছে। ১৯৩০ সাল থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠান আজও অমলিন আজও বাংলার প্রতিটি মানুষ মহালয়ার পূন্য প্রভাতে এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এখনও বহু মানুষের কাছে মহালয়া মানে বিশেষ গীতি আলেক্ষ এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।






            শেষ করার আগে সর্বশক্তিময়ী দূর্গতিনাশিনী অসুরদলনী দেবী দূর্গার কাছে জোড় হাতে নতমস্তকে প্রার্থনা করে বলি
                                        “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিবূপেণ সংস্থিতা নমস্তই নমস্তই নমো নমঃ”।“..........................
                                        রূপম দেহী, জয়ম দেহী, যশো দেহী, দ্বীশো জহী” ।










Comments

Popular posts from this blog

বাঁকুড়ার টেরাকোটা

                                                                বাঁকুড়ার টেরাকোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা  ভারতের শিল্পকর্মের এক বিশেষ স্থান   অধিকার করে আছে।  বাঁকুড়ার  পোড়ামাটির  ঘোড়া ও হাতি নির্মাণের  প্রধান শিল্প  কেন্দ্র গুলি   হল পাঁচমুড়া,  রাজাগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর।  প্রত্যেক শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব স্থানীয় ধাঁচ ও  শৈলী রয়েছে। এগুলির মধ্যে পাঁচমুড়ার  ঘোড়াগুলিকে চারটি ধাঁচের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম  বলে মনে করা হয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া এক  ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়াও বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী উট , হাতি , গনেশ ,  নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মূর্তি তৈরী করে  টেরাকোটা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।  রাঢ় অঞ্চলে স্থানীয় লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজায় টেরাকোটা ও কাঠের ঘোড়া ব্যবহৃত হয়। অনেক গ্রামে বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গ্রামবাসীরা ঘোড়া মা...

আমার ছড়া

      ।। সধবার একাদশী ।।                                    কাবলিওয়ালার ব‌উ দেখিনি পাঞ্জাবীদের টাক দেখিনি বোরখা পরে তোলা সেলফি দেখিনি নাঙ্গা বাবার  কাপড়জামা দেখিনি। গুজরাটেতে মদ চলেনা অরুনাচলে মদের নিষেধ চলেনা নৈনীতালে ফ‍্যান চলেনা লে লাদাকে রেল চলেনা। আইসক্রীমে বরফ নেই শ‍্যাওড়া গাছে পেত্নী নেই কৃষ্ণনগরে কৃষ্ণ নেই আজ লাইফ আছে জীবন নেই।                      ।। রসগোল্লা ।।                             পান্তোয়া সন্দেশ যতকিছু আনোনা বাংলার রসগোল্লা তার নেই তুলনা। নানাভাবে তোলপাড় কতকিছু ঝামেলা নবীনের নব আবিষ্কার নাম রসগোল্লা। আসল ছানার গোল্লা সে...

অপরাজিতা

অপরাজিতা বহু বৈচিত্রে ভরা অপরাজিতা।  দেবী দূর্গার বিভিন্ন রুপের মধ‍্যে আরও একটি রুপ হল  অপরাজিতা। অপরাজিতা কথার অর্থ অপরাজেয় অর্থাৎ যাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনা।   মহর্ষি বেদব‍্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী অপরাজিতা দেবীকে আদিকাল থেকেই শ্রেষ্ঠ শক্তিদায়িনী রুপে মান‍্যতা দেওয়া হয়েছে। ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ছাড়াও অন্যান্য দেবতারা নিয়মিত আরাধনা করেন। বিজয়া দশমী বা দশেহরার সময় শক্তির রুপীনির আর এক প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়ে থাকে যাতে জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে যেন জয়ী হ‌ওয়া যায়। অপরাজিতা পুজোর পর সেই লতা হাতে ধারণ করার রীতি অনেক স্থানেই চালু আছে। মানুষের বিশ্বাস এই অপরিজিতা রুপে দেবী দূর্গা সমস্ত অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে ধর্মের পূণঃপ্রতিষ্ঠিত করে। দেবী পূরাণে ও শ্রী শ্রী চন্ডীতে এরকম কাহিনী বর্ণীত হয়েছে।             ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে এই ফুলের আবিষ্কার যার ব‍্যাপ্তি সুদূর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা পর্যন্ত। ভারতের মোটামুটি সব স্থান ছাড়াও বিদেশে যেমন ইজিপ্ট, সিরিয়া, মেসো...