এর আগে তিনবার দার্জিলিংযাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করেও নানা কারণে সম্ভব হয়নি।তাইএবার দার্জিলিংএর আশপাশেএকটু নিরিবিলি স্থানে শান্তপরিবেশে
প্রকৃতির সৌন্দর্যতার স্বাদ নেওয়াই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য।
NJP স্টেশনথেকেআগেথেকেগাড়িতেভোরেশুরুহলোযাত্রা
44 কিমি দুরে লাটপানচার।সকালে ঘন কুয়াশা
কিছুটা নিরাশকরে দিলো।সিকিম হাইওয়ে ধরে কালিঝোরা থেকে বাঁক নিয়ে চড়াই ও ততোধি কখারাপ
13 কিমি রাস্তা শুরু হলো। 8 টার সময় পৌঁছলাম পদম গুরুং এর হোমস্টে। হার হিম করা ঠান্ডায় গরম চায়ের উষ্ণ অভ্যর্থনার পরএকটু বিশ্রাম
করে শুরুহলো আমাদেরযাত্রা।পায়ে পায়ে এগোলাম 2 কিমি দুরে সারসরি ধারারা দিকে,
যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্গা ভালো দেখা যায়। রাস্তা ভালো হলেও চড়াই উৎরাইএ অসুবিধে হচ্ছিলো।কিন্তু কুয়াশা আরও ঘনহ ওয়ায় শেষ পর্যন্ত
না গিয়ে ফিরে এলাম। বিকেলে গাড়ি ভাড়া
নিয়ে মহানন্দা জঙ্গলসাফারি।ঘন জঙ্গলে হাতির দল বেরনোয় বেশি ভেতরে যাওয়া সম্ভব হলোনা। কিন্তু নতুন অভিজ্ঞতা হলো সিঙ্কনা গাছের ঘন জঙ্গল দেখে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন তৈরীতে একসময় এই গাছের খুব চাহিদা
থাকলেও আজ প্রয়োজন কমে এসেছে, তাই এখন লাভজনক না হলেও কোনরকমে এই প্রকল্প চলছে।
পরদিন ছিলো ভোর ছটায়
বার্ড স্যাঙ্গচুয়ারি দর্শন। নানাধরনের প্রায়
দুশতাধিক পাখি এই এলাকায় দেখা যায়। অতো নাপেলেও আমরা
নিরাশ হইনি। বিশেষকরে Rufus
necked Hornbill, Blue whistling thrush, Grey wing black bird, Black crested
bulbul, Orange bellied, leaf bird ও আরো
কত নাম না জানা পাখি অন্যতম। এরপরে আমাদের গন্তব্য অহলধারা
view point. যেখান থেকে খোলা আকাশের নিচে একাধিক সবুজ পাহাড় ও চাবাগানের
দৃশ্য অবর্ণনীয়, কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকায় এখানেও কাঞ্চনজঙ্গার দেখা পাইনি। ফেরার পথে নামদিন লেক দর্শন
, লেকে এইসময় জল না থাকায় সালামান্ডার
দেখা সম্ভব হয়নি।এরপরদিনতিনচুলেযাত্রা।
দ্বিতীয়পর্বেরযাত্রা
50 কিমি দুরে তিনচুলে অভিরাজ হোমস্টে।কালি ঝোরার দূর্গম
রাস্তাএড়িয়ে সেল্পু হয়ে ঘন শালবনের ভেতর দিয়ে
NH10 ধরলাম। একটু এগিয়ে তিস্তার ধার দিয়ে অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে
যাওয়া। এরপর শুরু হলো দার্জিলিং
যাওয়ার চড়াই। প্রথম স্টপেজ লাভার্স
ভিউ পয়েন্ট।
এখান থেকে পাহারের
নিচে তিস্তা ও রঙ্গীত নদীর সঙ্গম স্থল, মনোরম এই দৃশ্যের আবেশ অনেক দিন মনে রাখার মতো। কিছুক্ষন পর আবার যাত্রা শুরু। পেশক মোড়ে এসে বাঁ দিকের চড়াই রাস্তা ধরে পেশক চাবাগানের ভেতর
দিয়ে যাচ্ছি।
5 কিমি রাস্তা খুবই খারাপ, চাবাগান বন্ধ তাই রাস্তার এই হাল। খানিকটা এগিয়েই থামলাম বাঁ দিকে অভিরাজ হোমস্টে আর ডান দিকে
পাইনের ঘন জঙ্গল।

চা খেয়ে একটু বিশ্রাম
নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে বেড়লাম। রাস্তার দুধারে
আকাশ ছোঁয়া পাইনের ঘন অন্ধকার জঙ্গল এতই গভীর সূর্যের আলো পর্যন্ত্য ঢুকতে পারেনা। খুবই নিরিবিলি গা ছমছম করা পরিবেশ,
নানা পাখির কিচিমিচি শব্দ আর মাঝে মাঝে এক দুটো গাড়ী যাওয়ার
শব্দ, এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। দুপুরের খাওয়া সেরে
মেঘলা আকাশ আর প্রকৃতির শান্ত পরিবেশ দেখতে দেখতে কখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো বুঝতেই
পারিনি।
 |
কাঞ্চনজঙ্গা |
 |
Add caption |
পরের দিন গাড়ী নিয়ে যাই
তাকদা অর্কিড সেন্টার, প্রাচীন মনেস্ট্রী
আর বড়মাঙ্গয়ার ফার্ম হাউস। ফার্মেরই একজন আমাদের
ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল এই সাজানো বাগান। বিগফার্ণ, রুদ্রাক্ষ, তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, রনডেনড্রন, কমলালেবু, পাহাড়ী কারিপাতা , গোলাপজাম, কফিগাছ, একাধিক সুন্দর সুন্দর ফুল ও আরও কয়েক শত নানা রকম গাছ গাছালি দেখে ওখানকার ফ্যাক্টরী দেখে
কিছু জ্যাম জেলী আচার ও কমলাখোশার পাউডার ইত্যাদি কিনে ফিরে আসা।
 |
কাঞ্চনজঙ্গা, স্লিপিং বুদ্ধ |
পরদিন সাড়ে পাঁচটায় ভোর
রাতে দেখি সারা আকাশ লাল হয়ে গেছে। কাল রাতে আকাশ ভর্তি
তারা দেখে সবাই বলেছিল আজ আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি উঠে খোলা ছাদে দেখি এক মোহময় দৃশ্য যা প্রত্যক্ষ
করার জন্য বহুদূর থেকে মানুষ জড়ো হয়।সোনালী রঙ্গে সেজে একটু একটু করে জেগে উঠছে কাঞ্চনজঙ্ঘা,
ক্রমে হিমালয়ের অন্য চূড়া গুলোও জেগে উঠেছে। সব মিলিয়ে তৈরী হয়েছে ঘুমন্ত বুদ্ধ বা
sleeping Buddha. বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকি হিমালয়ের শোভার দিকে।
ধীরে ধীরে সোনালী আভা
কাটিয়ে রজতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্য চূড়া গুলো দৃশ্যমান হয়ে এক অলৌকিক পরিস্থিতি তৈরী
করেছে। এইভাবেই প্রায় নটা
বেজে গেল, আর অপেক্ষাকরা চলবেনা । ড্রাইভার তাগাদা
দিচ্ছে আজ আমাদের একদিনের দার্জিলিংসফর।
 |
পাহাড়ের ওপর দার্জিলিং বসতি |
যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভবপ্রস্তুত
হয়ে 27 কিমি
দূরে দার্জিলিংএর উদ্দেশে রওনা দিলাম। চা বাগানের ভাঙ্গা
চোরা রাস্তা পেরিয়ে নামলাম পেশক রোডে, 7 কিমি দুরে প্রথম
স্টপেজ লামাহাট্টা। রাস্তার ধারে
তাকদা ফরেস্টের এক প্রান্তকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরী হয়েছে পার্ক। খানিক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল।বেঁকে বেঁকে চড়াই
রাস্তা, পাশ ফিরতেই দেখি কাঞ্চজঙ্ঘা এখনও আমাদের সামনে প্রকট হয়ে আছে আর দেখা যাচ্ছে ঘন বসতি পূর্ণ
দার্জিলিং পাহাড়। ছবিতোলার জন্য
একটা ফাঁকাজায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেহলো। আরও কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে হিলকার্ট রোড ধরে পৌঁছলাম ঘুম। আগের চেনা জানা শান্ত ঘুমন্ত ঘুম পেলামনা। এখন জনবহুল ব্যাস্ত ঘুম, কংক্রিট আর যান
চলাচলের আধুনিকতার স্পর্শ সর্বত্র।ঘুম মনেস্ট্রী বেড়িয়েই শুনতে পেলাম রেল
ইন্জিনের শব্দ। চকিত ফিরতেই দেখি দুটো বগি নিয়ে নিজের পুরনো ছন্দেএগিয়ে আসছে
1891 থেকে চলে আসা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা
পাওয়া (DHR) দার্জিলিং এর টয় ট্রেন। অসীম আনন্দ নিয়ে বিহ্বল হয়ে দেখলাম,
কিছুক্ষণ পরেই আর একটা ট্রেন। মনের মতো কয়েকটা ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললাম বাতাসিয়া লুপ।এক অসাধারন সুন্দরজায়গা,
চারিদিকে সবুজ পাহাড় আর অজস্র ছোট ছোট বাড়ী। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি ও রেল লাইন ধরে হাঁটার পর আবার ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে এল সেই ট্রেন,
তারপর পাকদন্ডি ঘুরে চলে গেলো।
 |
দার্জিলীং টয় ট্রেন, ঘুম |
 |
বাতাসিয়া লুপ |
এটা না পেলে বাতাসিয়া লুপ দেখা অপূর্ণই থেকে যেতো। এরপর চাবাগান পরিদর্শন
যেখান থেকে থাকে থাকে সাজানো চাবাগানের পাহাড় আর লেবং রেসকোর্স দেখা যায়। এরপর রাস্তায় পড়লো রোপওয়ে স্টেশন। আমরা না চড়লেও বেশ
নিচে থেকেই কিছুক্ষণ এর যাতয়াত উপভোগ করে এগিয়ে চললাম পদ্মজা নাইডু হিমলয়ান জুলজিক্যাল
পার্ক (Zoo) ও হিমালয়ান মাউটেনিয়ার্স ইনস্টিউট
(HMI). ঢোকার টিকিট
50 টাকা ও ক্যামেরার
10 টাকা। ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন পশুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য Samber,
Blue ship, Braking deer, Yak, Blue sheep, Royal Bengal Tiger, Tibetan wolf,
Snow leopard, Black leopard ইত্যাদি
ও নানারকম পাখি।
 |
হিমালয়ের স্নো লেপার্ড |
 |
টিবেটিয়ান উল্ফ |
এরই মাঝে HMI মিউজিয়াম দর্শন। হিমালয়ে মাউন্টেনিং
এর বিভিন্ন সামগ্রী, মূল্যবান ছবি ও হিমালয়ের নানা পশুপাখির আসল চেহারা দেখে রোমাঞ্চিত
হতে হয়।পরের স্থান ঐতিহ্য বাহি দার্জিলিং ম্যাল। সময় পাল্টালেও এই জায়গার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। শতাধিক মানুষের সাথে ঘোরাঘুরি মাঝে অল্পবিস্তর কেনাকাটা ও কিছু
খাওয়া দাওয়া করে আড়াই তিন ঘন্টা কেটে গেছে। পাহাড়ী রাস্তা ফেরার তাগাদা আছে তাই ড্রাইভারের খোঁজ করে তিনচুলে
প্রত্যাগমন। আগামীকাল সকালে
আমাদের গন্তব্যকার্শিয়াং।
 |
কার্শিয়াং স্টেশন |
শেষ পর্বের যাত্রা তিনচুলে
থেকে কার্শিয়াং।
44 কিমি
, দুঘন্টা পর বারটায় কার্শিয়াং টুরিস্ট
লজ পৌঁছলাম। প্রথম দিনটা কার্শিয়াংএর ছোট্ট জিলেবী বাজার ঘুরে লজেই বিশ্রাম
করেকাটিয়ে দিলাম। পরদিন ভোরে আরও সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলো। প্রায়
ঘন্টা খানেক
অপেক্ষা করে এক এক করে প্রকট হচ্ছে সোনালী রঙের সব চূড়া,
তারপর পরিষ্কার হলো স্লিপিং বুদ্ধ।
 |
নেতাজীর স্মৃতি জড়িত বাড়ী, কার্শিয়াং |
 |
পাহাড়ের গায়ে কার্শিয়াং |
ব্রেকফাস্ট করে তৈরী
হয়ে বেরলাম বিভিন্ন দ্রস্টব্য স্থান। কার্শিয়াং স্টেশনের পাশ দিয়ে খানিকটা উপরে গিড্ডা পাহাড়
, এখান থেকে কার্শিয়াং শহরটা ছবির মতো লাগে। কাছেই
নেতাজী সুভাষের স্মৃতি জড়িত মিউজিয়াম। যদিও মেরামতির কাজ চলছে
, অগোছাল অবস্থাতেই ওখানের কেয়ারটেকার
পদম বাহাদুর ছেত্রী সব কিছু ঘুরিয়ে দেখালো আর নেতাজী ও তাঁর পরিবারের অনেক মূল্যবান
তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করলো। অসুস্থ হয়ে নেতাজী এখানে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েও যান। তাঁদের
ব্যবহৃত খাট , টেবিল, চেয়ার ও অন্যান্য আসবাব পত্র দেখে আবেগ প্রবন হতে হয়। এছাড়াও
নিজের স্ত্রী কন্যা, পরিবার ও অন্যান্য বিশেষ ব্যাক্তি যেমন হিটলার,
গান্ধিজি, নেহরু, রবিঠাকুর ইত্যাদির সাথে ছবি ও চিঠিপত্রর সংগ্ৰহ উল্লেখযোগ্য।
এরপরের দ্রস্টব্য ইগল
ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকেও গোটা কার্শিয়াং ও অন্যান্য পাহাড়ের সৌন্দর্য্য
অতুলনীয়। এবার আমরা উঠতে শুরু করলাম ডাউ হিল। পাইন
গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বাঁকা সরু রাস্তা দিয়ে ওপরে ডাউ হিল ডিয়ার পার্ক,
ডাউ হিল স্কুল দেখে ঐ সরু রাস্তা দিয়ে নেমে এলাম।খাওয়া সেরে আজকের
মতো বিশ্রাম।কাল ফেরার পালা।
 |
চা গাছের ফুল |
 |
চা বাগান |
ব্রেকফাষ্ট সেরে একবেলা
বিশ্রাম। লাঞ্চের পর দুটো নাগাদ ফেরা শুরু। পাঙ্খাবাড়ি
রোড দিয়ে য়াওয়ার সময় মকাইবাড়ী টি এস্টেট, চা পাতার অভাবে কারখানায় প্রসেসিং বন্ধ তবুও অনুমতি নিয়ে ভেতরে
ঢুকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেখে বুঝে বহুদিনের ইচ্ছে কিছুটা প্রশমিত করলাম। নানা
দামের কিছু চাপাতা কিনে নিচে নামতে শুরু হলো।
ধীরে
ধীরে পাহাড় শেষ করে সমতলে নেমে এসে মনটা বেশ ভারা ক্রান্ত হয়ে গেল। মাঝে
লংভিউ চাবাগানে নেমে ঘুরে দেখা হলো, সুন্দর
করে ছাঁটা ঘন সবুজ বাগান দেখে মন ভরে গেলো। ফেরার পথে শিলিগুড়িতে কিছুটা সময়
কাটিয়ে আবার সেই NJP স্টেশন।
কিছু পরেই পদাতিক এক্সপ্রেস
ছাড়বে গত নদিনের ব্যস্ত সফরের শেষ। অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার ভ্রমন বিবরনের প্রচেষ্টা
যারা পড়লেন তাদের ধন্যবাদ।
মনে হচ্ছে ওখানে ই চলে গেছি।সুন্দরহয়েছে লেখা টা।
ReplyDelete