Skip to main content

অরুণাচলের ডায়েরী


এবারের যাত্রা অরুণাচল,সূর্যোদয়ের দেশ।ভারতবর্ষের প্রথম সূর্যোদয় দেখা যায় এখান থেকেই। এছাড়া এখানকার প্রধান আকর্ষন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। অরুণাচল যেতে ইনার লাইন পারমিট (ILR)দরকার হয়। সেইমতো সমস্ত কাগজপত্র
রেডি করে রওনা দিলাম। এবার আসল রহস্য উদ্ঘাটনের দরকার, আমরা সমস্ত রাস্তাটাই রোড জার্নি করছি ডাস্টার(AWD)এ সওয়ারী হয়ে। সারথী আমাদের জামাতা অরিত্র।মূলত তারই আগ্রহ ও রোমাঞ্চকে ফলপ্রসু করার জন্যই আমাদের সঙ্গ দেওয়া। সঙ্গে আমার স্ত্রী মৌসুমী,আমাদের মেয়ে ঋতুপর্ণা ও তিন বছরের নাতি রিয়ন।

কোলকাতা থেকে রাত ১টায় যাত্রা শুরু। ফরাক্কা ব্রীজ পেড়িয়ে বেশ কিছুদুর যাওয়ার পর নটা নাগাদ একটা ছোটখাটো দোকানে চায়ের জন্য দাড়ালাম,সেখানে হাল্কা ব্রেকফাস্ট করে আবার যাত্রা। মাঝে রাস্তায় লাঞ্চ সেরে শিলিগুড়ি পৌছলাম তখন বিকেল চারটে, এখানে আমাদের প্রথম রাত্রির বিশ্রাম। পরদিন ভোর ৫টায় গাড়ী চলা শুরু । এর পরের গন্তব্য ৪৭৫ কিমি ,গৌহাটি থেকে আরও এগিয়ে মঙ্গলদই বলে একটা ছোটখাটো শহর।
NH17 ধরে জলঢাকা নদীর ব্রীজ পেরিয়ে এগিয়ে চলা , মাঝে বাঁদিকে ভূটান বর্ডার। ভুটানের মিষ্টি কমলালেবুর পসরা নিয়ে রাস্তার ধারে ভূটানী মেয়েরা বসে আছে। দাম বেশী হলেও ব্যাগ ভর্তি লেবু কিনলাম। এইভাবেই  বিকেল প্রায় ৫টায় দ্বিতীয় রাতের বিশ্রামের জন্য মঙ্গলদইএর এক হোটেলে থামলাম। পরদিন সকাল ৬-২০তে আবার শুরু করলাম। পরের গন্তব্য ২৫০ কিমি দুরে অরুনাচলের দিরাং। উদলগিরি হয়ে আমাদের অরুনাচল যাত্রা শুরু। ২১১কিমি দুরে বোমডিলা মাঝে ৬৫কিমি এগিয়ে গেলেই ভৈরবকুন্ড, অরুনাচলের বর্ডার, আর কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরেই পাহাড়ি রাস্তা শুরু হলো চড়াই উৎরাই। অরুণাচল ঢুকতেই রাস্তায় একবার সেনাবাহিনীর চেকিং। আমাদের অবশ্য কিছু না দেখেই ছেড়ে দিলো, জানিনা গায়ে থাকা মিলিটারির ছাপা জ্যাকেট ও টুপি অধিক সম্মান দিলো কিনা।
আঁকাবাঁকা জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা, সামনেই নজরে পড়লো খাড়া পর্বতরাশি, কোনোটা সবুজ আবার কোনোটা গাছপালহীন কালো পাথর, তারই মাঝে চুনাপাথরের সাদা প্রলেপ যাকে বরফ ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠছি। তখনও বুঝতে পারিনি এর থেকে আরও কয়েক গুন রোমাঞ্চকর দৃশ্যের সাক্ষী হতে চলেছি। যতো উপরে উঠছি প্রকৃতির রুপ ততই মোহিত করছে। নিজেদের গাড়ী বারবার থামছি আর মোবাইল ও ক্যামেরাতে ছবি তুলে চলেছি।ভৈরবকুন্ড থেকে ১৩১কিমি দুরে ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ী শহর রুপা। পাহাড়ের গা বেয়ে নদীর ধারে ছোট বড়ো নানাধরনের বাড়ী। সঙ্গে রয়েছে মিলিটারী ব্যারাক।খুবই সাজানো গোছানো এলাকা। নদীতে বেশী জল নেই, এবড়ো খেবড়ো পাথর তার মধ্যে ডাস্টার নামিয়ে টেস্ট করা হলো। ঘন্টা খানেক  প্রকৃতিকে উপভোগ করার পর বুঝলাম ২-৩০টে বাজে।কাছেই মিলিটারী ক্যান্টিনে বিশেষ কিছু না পাওয়ায় সোজা বোমডিলার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ১৭কিমি রাস্তা প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবে।
৩-৩০টে নাগাদ বোমডিলা পৌঁছলাম, এখানকার থুকপা বিখ্যাত। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একটা রেস্টোরেন্টে থুকপার অর্ডার দিলাম। গরম গরম খাবার এই ঠান্ডায় খুবই উপাদেয় লাগলো। অরুনাচলে ৪টে ৪-৩০টে তেই সন্ধে নেমে আসে তাই স্থানীয় দর্শনীয় জিনিসগুলো দেখা হয়ে উঠলনা। রাস্তার ধারে আখরোট,কাজু, নানারকম ডাল,শুকনো বীফ ইত্যাদির পসরা নিয়ে স্থানীয় মেয়েরা বসে আছে। যাইহোক অন্ধকার নামার আগেই দিরাংএর উদ্দেশে রওনা দিলম। ৪২কিমি রাস্তা পার করে প্রায় দেড় ঘন্টা পরে দিরাংএর নির্দ্দিস্ট হোটেল আউ রিসর্টে পৌঁছলাম। প্রায় ৫০০০ফুট উপরে NH13 ধারেই দিরাং শহর। পরের দিন স্থানীয় জায়গাগুলো দেখতে বেরোবো। ঠান্ডায় আজ আর কোনো কাজ নেই বিশ্রাম।
হোটেল থেকেই একজনকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। সীপ অর্চাড ঘুরে সাঙ্গতি ভ্যালী । ঘন সবুজ জঙ্গলে মোড়া পাহাড় ও তার নিচে ভ্যালীর মধ্যে বয়ে চলা বেশ চওড়া পাথর বেছানো নদী এগিয়ে চলেছে, অনেকটা কাশ্মীরের লীডার নদী ও ভ্যালী বা তার থেকেও আরও আকর্ষনীয় প্রাকৃতীক সৌন্দর্য্য।
পথে গাছ ভর্তি কমলালেবু উপরি পাওনা। এরপর গেলাম এখানকার সবথেকে উল্লেখযোগ্য বস্তু কিউইর বাগান। কিছুদিন আগেই বেশিরভাগ গাছ থেকে ফল তুলে নেওয়া হয়েছে তবুও কোন কোন গাছে এই অমূল্য ফলের দেখা পেলাম। নিজের চোখে গাছের ডালে কিউই ঝুলে থাকতে দেখা ও হাতে স্পর্শ করা এক দূর্লভ অভিজ্ঞতা। এরপর আরও দূর্গম পথ বেয়ে ৮২০০ ফুট ওপরে অ্যাপেল অর্চাড দেখতে ওঠা। দূর্ভাগ্যবশতঃ কিছুদিন আগে আগুন লাগার ফলে আপেল বা তার গাছ দেখতে পাইনি। কিন্তু আরও একটু ওপড়ে উঠে বিশাল হেলিপ্যাড ও চারপাশে ঘিরে থাকা হিমলয়ের নানান নাম না জানা পর্বতমালা। কোনোটা একদম তুষারাবৃত, কোনোটা আংশিক তুষারাছন্ন,আবার কোনটায় এখনো তুষারের ছোঁয়া লাগেনি। এরপর কিছুটা নেমে এসে কামেং নদীর ধারে উষ্ণ প্রস্রবন ও দিরাং মনেস্ট্রী ঘুরেঘুরে দেখলাম।

পরদিন সকালবেলায় গোছগাছ করে তাওয়াং এর উদ্দেশে রওনা হলাম। ১২৮কিমি পাহাড়ী রাস্তা দুরে ১০০০০ফুট উপরে তাওয়াং অরুনাচলের এক জেলাশহর। যদিও চীন মনে করে এটি দক্ষিন তিব্বতেরই একটা অংশ। ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক দিক থেকে তাওয়ংএর গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯১৪ সালের সিমলা কনভেনশন অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার ভারত ও তীব্বত সীমারেখার জন্য যে ম্যাকমোহন লাইন ঠিক করা হয়েছিলো চীন তা মানতে রাজি হয়নি।  অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এবং বিভিন্ন ঘটনার পরবর্তী কালে ১৯৬২ ভারত চীন যুদ্ধের পর তাওয়াং সাময়িক চীনের দখলে যায় পরে আবার ভারত সরকারের শাষনে এলেও চীন এখনো অরুনাচলের অধিকাংশ এলাকার দাবী থেকে সরে আসেনি।
NH13 ধরে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে উপড়ে উঠে চলেছি। ৬২ কিমি দুরে ১৩৭০০ফুট উপড়ে সেলা পাস। কাছাকাছি যেতেই পাহাড়ের গায়ে বরফের আস্তরণ। যতো বরফের মাত্রা বাড়ছে উত্তেজনা ততো বাড়ছে। একটু এগিয়েই সেলা লেক। প্রচন্ড ঠান্ডায় সমস্তটাই জমে বরফের আকার ধারন করেছে। গাড়ী থেকে নামলাম,হাই অল্টিচিউড হওয়ার জন্য সাময়িক শরীর অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছিলো।  ৫-৭মিনিটের মধ্যেই স্বাভাবিক হলাম। খনিক্ষন চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দ্যর্য উপভোগ করে আবার এগিয়ে চললাম। রাস্তার ধারে পাহাড়ী ঝর্ণাগুলোর বেশিরভাগটাই জমে বরফ হয়ে আছে, কোথাও জলের ধারার অবস্থাতেই জমে গেছে। আবার কোথাও গোটা রাস্তাটাই বরফ জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে, খুব সন্তর্পণে গাড়ী এগোতে হচ্ছে। এক জায়গায় প্রচুর তুষারপাত দেখে গাড়ী থেকে নেমে বরফের খেলায় মেতে উঠেছি,সামনে শুধু তুষারাবৃত পর্বত আর ঠান্ডায় কাঁপছি। নিজের চোখে প্রকৃতির এই নৈস্বর্গিক রুপ দেখে যা অনুভব করা যায় তার সবটা
হয়তো প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর একটু এগিয়ে যসবন্তগড় ওয়ার মেমোরিয়াল। ১৯৬২ যুদ্ধের স্মৃতি ও সৈনদের মনোবল বাড়ানর জন্যই ১৪০০০ ফুট উচুতে তৈরী এই সৌধ। প্রধান  দ্বারে সৈনরা গরম কফি ও স্ন্যাক্স নিয়ে অপেক্ষা করছে। শরীরটা একটু গরম করে উপরে উঠলাম।এই সৌধ না দেখলে সেলা পাস ভ্রমন অসম্পূর্নই থেকে যেতো। মাঝে মাঝে দেখি ইয়াকের দল ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে , কোথাও আবার রাস্তায় আমাদের গাড়ীর কাছাকাছি চলে আসছে।নির্জন তুষার মাখা পাহাড় গুলোকে একলা রেখে আবার এগোতে শুরু করলাম । তাওয়াং থেকে ৪০ কিমি আগে জঙ্গ শহরের কাছে নুরানং ফল্স। অরুনাচলের এটি একটি অত্যাশ্চর্য্য ফল্স। ১০০ ফুট উচু এই ঝর্নার উৎপত্তি সেলা লেক ওতাওয়াং নদীর সঙ্গে মিসছে। এই ফল্সের সৌন্দর্য্যতা খুবই আকর্ষণীয় এবং জঙ্গ ফল্স নামেও পরিচিত।

তাওয়াং হোটেলে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সারাদিনে যাত্রাপথের ধকল আর এখানের হাড় হিম করা ঠান্ডায় আমরা আর ঘর থেকে বেরোতে পারলামনা। পরদিন সকালে লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রাশন অফিস থেকে বুমলা পাস ও চীনের বর্ডার যাওয়ার পারমিশন নিতে গেলাম। হোটেল বা লোকাল ট্যাক্সির মত অনুযায়ী তাদের গাড়ী ছাড়া বুমলা পাস যাওয়া যাবেনা।অ্যাডমিনিস্ট্রাশন অফিসে গিয়ে কিন্তু ধারনা বদলে গেলো। দ্রুত তৎপরতার সঙ্গে তারা  পারমিশনের প্রথম ধাপের কাগজ দিয়ে দিলো। তারপরের ধাপের জন্য মিলিটারি অফিসে জমা দিতে হলো, পরদিন সকাল
৮টার মধ্যে সেই পারমিশনের কাগজ পাওয়া যাবে। আজ আমাদের লোকাল সাইট সিয়িং ও মার্কেট ঘোরা। উল্লেখযোগ্য হলো ওয়ার মেমোরিয়াল । ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধের স্মৃতিতে তৈরী হয়েছে ওয়ার মেমোরিয়াল ও মিউজিয়াম। বিভিন্ন যুদ্ধের ঘটনার ব্যক্ষ্যা  শুনে ও যুদ্ধের নানা সামগ্রীর সাক্ষী হয়ে রীতিমতো রোমাঞ্চিত হতে হয়।এখানকার স্মৃতিসৌধটি বৌদ্ধ নিয়ম মেনে প্রতিদিন পুজো করা হয়।
এরপর যথারীতি শপিং।এখানকার বাজারে খুব ভালো ভালো জ্যাকেট ও নানারকম জুতো পাওয়া যায়, দরাদরি করে কিনলেই হলো। তবে রেষ্টোরেন্টে সতর্ক থাকার দরকার,চারিদিকে ইয়াক ও বিফের ছড়াছড়ি।
পরদিন সকালেই তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম। অরুনাচল ভ্রমনের আজই গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৫২০০ ফুট উচুতে উঠতে হবে বুমলা পাস, ভারতের শেষ প্রান্তে চীনের বর্ডার। সেলা পাসের অসুবিধার কথা ভেবে একটা ছোট অক্সিজেন ক্যান সঙ্গে নিয়েছি। প্রথমেই মিলিটারি অফিস থেকে পারমিশনের ডকুমেন্ট নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। খুবই ভাঙ্গাচোরা  ও আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে উঠে চলেছি। কিছুটা যাওয়ার পর কুয়াশায় সমস্ত  পাহাড় ঢেকে আছে ,পাঁচ সাত ফুট দূরের রাস্তা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছেনা। খুবই সন্তর্পনে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি। কুয়াশা অনেকটা হাল্কা হচ্ছে পথের ধারেই পিটিসো [P T Tso (Pangang Teng Tso) Lake]লেক। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা এই লেকের দৃশ্য খুবই মনোরম। আরও কয়েক পাক উপরে ওঠার পর কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ দেখা গেলো। পাহাড়ের উল্টোদিকে তাকিয়ে হঠাৎ এক অবর্ননীয় দৃশ্য নজরে এলো  , পাহাড়গুলোর মাঝে কেউ যেন ধবধবে সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে । দুএকটা উচু পাহাড়ের চূড়া ছাড়া আর কিছুই নজরে আসছেনা। ধবধবে সাদা পাহাড়ের ওপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। তাওয়াং থেকে ২২কিমি Y জংশান , এখান থেকে বাঁদিকে ২০কিমি গেলে সাংগাটসার লেক আর ডানদিকে ১৮কিমি গেলে বুমলা। আমরা প্রথমে লেকের পথেই এগোলাম। ঘুরপাক ভগ্নপ্রায় পাকদন্ডী পেরিয়ে এগোচ্ছি। মাঝে মাঝে মিলিটারী ব্যারাক। ঠিক রাস্তার  জন্য সেনাদের কাছে জানতে হচ্ছে। এইভাবেই পৌঁছে গেলাম সাংগাটসার লেক (Shonga-tser Lake) ১৯৭১ সালে ভূমিকম্পের ফলে এই লেকের সৃস্টি , লেকের মাঝে বড় বড় গাছের অংশবিশেষ দেখলে যা বোঝা যায়। চারিদিকে বড়বড় পাহাড় ও মাঝখান জুড়ে এই বিশাল লেক। লেক ও আশপাশের এলাকা সেনারা খুব সুন্দরভাবে দেখাশোনা করে। প্রাকৃতিক সৌন্দ্যর্যে ভরপুর লেকের কথা অনেকদিন মনে থাকবে।এতো বেশী ঠান্ডা যে মিলিটারী ক্যান্টিনে গরম গরম ম্যাগী খেতেই হবে। আমাদের সঙ্গের নাতির জন্য জুস ও চকলেট দিলো, অনুরোধ স্বত্তেও দাম নেয়নি। বেশ কিছুক্ষন কাটিয়ে ঐ পথ ধরেই আবার ফেরা।




Y জংশান থেকে ডানদিকের পথ, গন্তব্য বুমলা। মাঝে রাস্তায় চেকপোস্টে একবার সমস্ত পারমিট চেক করা হলো। একই রকম এবড়োখেবড়ো রাস্তা বেয়ে পৌঁছলাম বুমলা, চীনের বর্ডার যা অটুট রাখার জন্য সদা জাগ্রত আমাদের দেশের প্রহরী। ১৫২০০ ফুট উপরে উঠে স্বাভাবিক ভাবেই শরীর একটু গোলমাল করছে , মাথা ঘোরাচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুবিধা হচ্ছে। দুতিনবার অক্সিজেন মুখে স্প্রে করার পর একটু একটু করে স্বাভাবিক হলাম। একজন সেনা তাড়াতাড়ি এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিস্কুট ও চকোলেট উপহার দিলো। ওই আমাদের দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল যে এখানেই ভারতের সীমা শেষ। গেটের এদিকটা অব্দি ভারত ঐ দিকটা চীন। হাল্কা তারের ঘেরা, আমাদের বলে দিলো ঐ পাশে যেন না যাই। কিভাবে কতবার  দুই দেশের বর্ডারের সেনাদের মধ্যে মিটিং হয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান বজায় থাকে।দুই দেশের ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক সীমারেখায় দাঁড়িয়ে নিজেদের রীতিমতো রোমাঞ্চিত বোধ হচ্ছিল। প্রায় আধঘন্টা সময় কাটিয়ে মনের মধ্যে অনেক কিছু সংগ্রহ করে আবার ফেরার জন্য তৈরী হলাম। ওই একই পথে একই ভাবে তাওয়াং ফিরলাম তখন ঠিক বিকেল ৫টা।
এবারে ফেরার রাস্তা। তাওয়াং থেকে ভালুকপং ৩০০ কিমি ,১২ ঘন্টা লেগে যাবে তাই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বেরোতে হলো। সেই একই পথে ফেরা তফাৎ শুধু রাস্তায় আরও বেশী বরফ আরও বেশী সাদা আরও বেশী উৎসাহ ও উদ্দীপনা। সেলাপাসের কাছে রাস্তার ওপর রাশি রাশি বরফ দেখে গাড়ী থেকে সবাই নেমে হইচই আর ছবি তোলার পালা। আবার চলা শুরু , পথে বৈশাখী নামে ছোট্ট এলাকা । হঠাৎ নজরে এলো রাস্তার দুপাশে পাইন ও ছোট ছোট ঝোপগুলো সাদা হয়ে আছে , অঝোরে তুষার পাত হচ্ছে আর আমরা ততই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছি।ইচ্ছে না থাকলেও গাড়ী চলতে শুরু করলো , জানিনা আবার কবে এই সুযোগ আসবে , মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। দিরাংএ এসে লাঞ্চ সেরে রুপা পার করে ভালুকপং এর রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তাটুকুর (প্রায় ৮০ কিমি) হাল খুবই খারাপ, রাস্তা নেই বললেই চলে। রাতের ঘন অন্ধকারে অতি সন্তর্পনে ধীর গতিতে এসে যখন ভালুকপং হোটেলে পৌঁছলাম তখন রাত ৮টা।

পরেরদিন ফেরার পালা। বিদায় অরুনাচল, গত ৯দিনের চড়াই উৎরাই এর পাহাড়ী সফর অনেক রোমাঞ্চ অনেক ভালোলাগা অনেক স্মৃতি নিয়ে এখানেই শেষ হলো। এরপর যাত্রা আসাম ও মেঘালয়।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

বাঁকুড়ার টেরাকোটা

                                                                বাঁকুড়ার টেরাকোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা  ভারতের শিল্পকর্মের এক বিশেষ স্থান   অধিকার করে আছে।  বাঁকুড়ার  পোড়ামাটির  ঘোড়া ও হাতি নির্মাণের  প্রধান শিল্প  কেন্দ্র গুলি   হল পাঁচমুড়া,  রাজাগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর।  প্রত্যেক শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব স্থানীয় ধাঁচ ও  শৈলী রয়েছে। এগুলির মধ্যে পাঁচমুড়ার  ঘোড়াগুলিকে চারটি ধাঁচের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম  বলে মনে করা হয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া এক  ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়াও বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী উট , হাতি , গনেশ ,  নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মূর্তি তৈরী করে  টেরাকোটা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।  রাঢ় অঞ্চলে স্থানীয় লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজায় টেরাকোটা ও কাঠের ঘোড়া ব্যবহৃত হয়। অনেক গ্রামে বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গ্রামবাসীরা ঘোড়া মা...

আমার ছড়া

      ।। সধবার একাদশী ।।                                    কাবলিওয়ালার ব‌উ দেখিনি পাঞ্জাবীদের টাক দেখিনি বোরখা পরে তোলা সেলফি দেখিনি নাঙ্গা বাবার  কাপড়জামা দেখিনি। গুজরাটেতে মদ চলেনা অরুনাচলে মদের নিষেধ চলেনা নৈনীতালে ফ‍্যান চলেনা লে লাদাকে রেল চলেনা। আইসক্রীমে বরফ নেই শ‍্যাওড়া গাছে পেত্নী নেই কৃষ্ণনগরে কৃষ্ণ নেই আজ লাইফ আছে জীবন নেই।                      ।। রসগোল্লা ।।                             পান্তোয়া সন্দেশ যতকিছু আনোনা বাংলার রসগোল্লা তার নেই তুলনা। নানাভাবে তোলপাড় কতকিছু ঝামেলা নবীনের নব আবিষ্কার নাম রসগোল্লা। আসল ছানার গোল্লা সে...

অপরাজিতা

অপরাজিতা বহু বৈচিত্রে ভরা অপরাজিতা।  দেবী দূর্গার বিভিন্ন রুপের মধ‍্যে আরও একটি রুপ হল  অপরাজিতা। অপরাজিতা কথার অর্থ অপরাজেয় অর্থাৎ যাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনা।   মহর্ষি বেদব‍্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী অপরাজিতা দেবীকে আদিকাল থেকেই শ্রেষ্ঠ শক্তিদায়িনী রুপে মান‍্যতা দেওয়া হয়েছে। ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ছাড়াও অন্যান্য দেবতারা নিয়মিত আরাধনা করেন। বিজয়া দশমী বা দশেহরার সময় শক্তির রুপীনির আর এক প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়ে থাকে যাতে জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে যেন জয়ী হ‌ওয়া যায়। অপরাজিতা পুজোর পর সেই লতা হাতে ধারণ করার রীতি অনেক স্থানেই চালু আছে। মানুষের বিশ্বাস এই অপরিজিতা রুপে দেবী দূর্গা সমস্ত অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে ধর্মের পূণঃপ্রতিষ্ঠিত করে। দেবী পূরাণে ও শ্রী শ্রী চন্ডীতে এরকম কাহিনী বর্ণীত হয়েছে।             ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে এই ফুলের আবিষ্কার যার ব‍্যাপ্তি সুদূর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা পর্যন্ত। ভারতের মোটামুটি সব স্থান ছাড়াও বিদেশে যেমন ইজিপ্ট, সিরিয়া, মেসো...